বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠিয়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে—
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালবাসো—
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদেরে ব্যর্থ নমস্কারে\
আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপটরাত্রি-ছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে।
আমি যে দেখেছি—প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে\
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে।
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে—
যাহারা তোমায় বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কবিগুরুর অমর ‘প্রশ্ন’ কবিতা আজ সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ন্যায়-সত্যের, ত্যাগ-তিতিক্ষার কোনো বালাই নেই। চারিদিকে স্তাবক আর চাটুকারে ছেয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সবাই দেশটাকে লুটেপুটে খেয়েছে, এখনও খাচ্ছে। কিন্তু যে কৃষক কিছুই না পেয়ে জাতীয় জিডিপির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অবদান রেখেছে, যে শ্রমিক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখেছে তাদের আজ মহাজোট সরকারের মহামন্ত্রীদের কাছে গালমন্দ শুনতে হচ্ছে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী দক্ষিণ অঞ্চলের কন্যা, এক সময় বঙ্গবন্ধুর পিঠের চামড়া দিয়ে জুতো বানাতেন, শেরপুরে বিয়ে না হলে, আওয়ামী লীগের টিকিট না পেলে সংসদ ভবন চিনতেন কি-না বলা যায় না—তিনি আজকাল বলছেন, কৃষকরা এবং গরিবরা সবচেয়ে বেশি অপচয় করে। সুধী সমাজে মন্ত্রী এ কথা উচ্চারণের আগে তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে এল না কেন? আল্লাহর কুদরতে তার কণ্ঠ থেকে জাতির প্রতি এমন অপমানজনক কথা বেরুবার আগে বন্ধ হয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি। বড় মর্ম যাতনার শিকার হচ্ছি এসব কথার প্রতিকার করতে না পেরে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ কিইবা ব্যয় করে আর তা থেকে কতইবা অপব্যয় করবে! আমাদের দেশের নতুন ধনবানরা এক বেলার খাবারে কেউ কেউ হয়তো লাখ টাকা খরচ করে। তারা কোনো অপব্যয় করে না! অপব্যয় করে সেই গরিব মানুষরা যারা ৬-৭ জনে মিলে একবেলায় একশ’ টাকাও জোগাড় করতে পারে না তারা? এমন চেতনার মহিলা মন্ত্রী দিয়ে আর যাই হোক মানুষের কোনো কল্যাণ হতে পারে না। যে গরিব থালা থেকে মাটিতে ভাত পড়লে খুঁটে খায়, জোট সরকারের কাছে তারা আজ খেতাব পেল অপব্যয়ী। আর যে ধনবানরা একজনের জন্য একশ’ জনের খাবার তৈরি করে প্রতিদিন ডাস্টবিনে ফেলে তারা হচ্ছে মিতব্যয়ী। কী আশ্চর্য ব্যাপার! এসব লাগামহীন কথার জবাব মহাজোটকে উপযুক্ত সময় মহারণেই পেতে হবে। জিয়াউর রহমানের সময় সচিব, এরশাদের মন্ত্রী আবার বর্তমান মহাজোটে মাননীয় অনর্থ মন্ত্রী এককাঠি এগিয়ে বলেছেন, গ্রামের কৃষকরা বড় বেশি বিদ্যুত্ অপচয় করে। কী বিচারবোধ! পুরো একটা গ্রামে ১০টা পাওয়ার পাম্পে যে বিদ্যুতের প্রয়োজন তার চেয়ে একশ’ গুণ বেশি বিদ্যুত্ বড় বড় ভুঁড়িওয়ালাদের এক অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে খরচ হয়। তারপরও প্রবাদের মতো, ঝাঁজর বা চালুন বলে সুইয়ের পাছা ট্যারা। মুড়ি ভাজার ঝাঁজর বা চালুন কিংবা ছাকনি যেটার পাছায় হাজারও ছিদ্র সে যদি বলে সুইয়ের পাছা ট্যারা বা ছিদ্র, তাহলে যেমন শোনায়, মাননীয় মন্ত্রীর এ মন্তব্যও ঠিক তেমনই শুনিয়েছে। কোনো বিবেকবান বিচারবোধসম্পন্ন মানুষ এমন মন্তব্য করতে পারেন না। আওয়ামী লীগের নামে কেউ এমন গণবিরোধী মনোভাব পোষণ করতে পারে—এটা ছিল সাধারণ মানুষের কল্পনারও অতীত। এমন মানসিকতা তো মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জননেতা শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লালন-পালন করা আওয়ামী রাজনীতির মানসিকতা হতে পারে না। এসব পণ্ডিতরা এক সময় বাম রাজনীতিতে শরিক ছিলেন। তাই বড় বিস্ময় জাগে কী করে তারা এতদিন এমন গণবিরোধী মনোভাব পুষে রেখেছিলেন। বাম ঘরানার দু’চারজন খ্যাতিমান রাজনীতিককে এই কয়েক বছর আগেও গার্মেন্টের মহিলা শ্রমিকদের মাতারি বলে ব্যঙ্গ করতে দেখেছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এদের যে কী ধাতুতে গড়েছেন তা তিনিই জানেন। প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট হয়েছে। অথচ শতকরা ৯০ জন সাধারণ মানুষ মুহিত সাহেবদের বাজেট নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাজারে চালের, ডালের, তেলের, নুনের দাম কত সেটা নিয়েই তারা বেশি চিন্তিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকলে সাধারণ মানুষ খুশি। ক্রয় ক্ষমতার বাইরে গেলে মহাসুন্দর বাজেটও তাদের হৃদয় স্পর্শ করে না। বাড়ির কাছে রাস্তাটা হলে তারা মনে করে দেশে উন্নতি হয়েছে। কাপড় ভিজিয়ে পারাপার হওয়া খালে কালভার্ট হলে তারা ভাবে দেশে উন্নতি হয়েছে। চোখে দেখার মতো কোনো পরিবর্তন না হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের উন্নতির কথা যতই বলা হোক তারা তা গ্রহণ করবে না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যেখানে কোনকিছুই হয়নি সেখানেই কেউ কেউ বলবেন, অনেক কিছু হয়েছে। চোখ-কান বুজে, বালুর মধ্যে ঠোঁট লুকিয়ে কাকের মতো সব কিছু অস্বীকারের কেমন যেন মারাত্মক রোগে পেয়েছে। কেউ কারও সীমায় থাকতে চায় না। কেউ কারও পজিশনে সন্তুষ্ট নয়। আরও আরও চাই, বড় বেশি করে চাই। এ যেন এক হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীর দেশ। ক’দিন আগে সংসদ সদস্যরা একজন প্রথিতযশা বরেণ্য ব্যক্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সমালোচনায় সংসদ ফাটিয়ে ফেলার অবস্থা করলেন। এ যেন নাই কাজ তাই খৈ ভাজের মতো। আমি বহু বছর যাবত্ যে কথা বলে চলেছি সেদিন হঠাত্ জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সে কথাটাই দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন। সরকার এবং বিরোধী দল নামে দুটি কিন্তু কার্যকরণে তারা এক ও অভিন্ন। এ উপলব্ধির জন্য তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে চাই। ইদানীং আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা তাত্ক্ষণিক সুবিধার আশায় বেশি সংখ্যক বুদ্ধিমান সত্য কথা বলেন না। যখন যা বললে সুবিধা হবে তাই বলেন। এই ক্ষেত্রে মনে হয় এই প্রথম একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। তাকে আবারও অকুতোভয় দেশবাসীর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
সেদিন হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি জনাব এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচার আসনে বসে যে ক্ষুব্ধতার পরিচয় দিয়েছেন— অমন গরম মেজাজের কাউকে অন্তত হাইকোর্টের বিচারপতি করা যায় না। অমন মাথা গরম থাকলে তার কাছ থেকে কারও ন্যায় বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। জনাব এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সম্পর্কে তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তাকে বিচারপতি বানানোর সময় কোনো পরীক্ষাও নেয়া হয়নি। কারণ তিনি আওয়ামী ঘরানার বা পছন্দের লোক। এরই মধ্যে তিনি বহু মানুষকে তার কোর্টে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই অপমান করেছেন। বিচারক হলো আল্লাহর প্রতিনিধি। এ জগত্-সংসারে কত কর্ম আছে কিন্তু বিচারকের আসন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যিনি বিচারকের আসনে বসেন তাকে স্রষ্টার কথা মনে রাখতে হয়। আল্লাহর কথা মনে করতে হয়। রাগ-অনুরাগের তার সুযোগ কোথায়? সবই তো আইন এবং বিবেকের কাছে বন্দী। ক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত হয়ে ন্যায় করবেন কীভাবে? শোনা যায় রেলের কর্মচারীদের তিনি বকাঝকা করেছেন; বিমানের এক শ্রেণীর টিকিট কেটে আরেক শ্রেণীতে ভ্রমণ করেছেন। নিজে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে এর ওর নামে নিজের কোর্টেই মামলা করেছেন—এ কি করে হয়? নিজেই বাদী, নিজেই তদন্তকারী, নিজেই বিচারক? এ তো হওয়ার নয়। ন্যায় ও সত্য এটাকে অনুমোদন করে না। কিন্তু তাই হয়ে এসেছে এতকাল। তাই প্রবীণ আইনজীবী সাহসী মানুষ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক যথার্থই বলেছেন, এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর আল্লাহর বিচার শুরু হয়েছে। আমাদের সংসদের মাননীয় স্পিকার বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ। তার ভাব ও ভাষায় বিস্তর আঞ্চলিক প্রভাব আছে। তিনি অবলীলায় আঞ্চলিক ভাব নিয়েই গর্ব ভরে কথা বলেন। কখনও কোনো হীনমন্যতায় ভোগেন না। কখনও সখনও তিনি দু’চারটি খাপছাড়া কথাও বলেন। এই কিছুদিন আগে বিরোধী দল ওয়াকআউট করায় প্রচণ্ড উত্তেজিতভাবে বিরোধী দল ও তাদের নেতা সম্পর্কে অনেক শক্ত শক্ত কথা বলেছেন। যেটা সংসদের অভিভাবক হিসেবে স্পিকারের মুখে বেমানান। কিন্তু তবু তিনি বলেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে সড়ক ভবনের মামলা নিয়ে সংসদ সদস্যদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রথম তিনি খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন, কোনো আদালত যদি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় তাহলে জনগণ আদালতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। সরকারও যদি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এটাই তো সত্য, খোদার দুনিয়ায় জনগণ পারে না এমন কী আছে? আইন করে পাকিস্তান থেকে আমরা বাংলাদেশ করিনি। জনগণ চেয়েছে রক্ত ঢেলে পাকিস্তানের সমস্ত আইন-কানুন ডুবিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। আল্লাহর পর জনগণই দেশের আসল মালিক-মোক্তার এটা সবাইকে বুঝতে হবে। না বুঝলে মাঝেমধ্যে যা হয় তাই হবে। এর কোনো নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। একজন বর্ষীয়ান জননেতা হিসেবে সংসদের স্পিকার জনাব আবদুল হামিদ জাতির অনুভূতিকে ব্যক্ত করেছেন। এ জন্য যেখানে তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য, সেখানে একজন বিচারক এজলাসে বসে মাননীয় স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। কেউ অপ্রকৃতিস্থ না হলে সংসদের কথা নিয়ে স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলতে পারেন না। সংসদে বলা কথা চ্যালেঞ্জ করার কোনো এখতিয়ার কারও নেই। আর বিশেষ করে আইনের দ্বারা যাদের হাত পা বাঁধা তাদের কেউ যদি নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের বিচার আসনে বসে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেন অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। বিচারালয় কাব্য করার জায়গা নয়, বিচারালয় ন্যায় বিচার করার স্থান। সেখানে বলার চাইতে লেখার দরকার বেশি। সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে, বিচারকের শপথ ভঙ্গ করে কেউ যদি বিচারের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড সংক্রমিত ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের রাজধানীর মহাখালীতে একটি মাত্র কলেরা হাসপাতাল। ফলে এই ভয়াবহ রোগ ছড়িয়ে পড়লে কাউকে বাঁচানো কঠিন হবে। তাই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আগেই রুখে দাঁড়ানো উচিত। সরকার এখানে সরকারের মতো আচরণ করছে না। তাই জনগণকেই দেশের মালিকানা প্রমাণ করার জন্য সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আর এভাবে কাউকে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে দেয়া যায় না। সে সরকারই হোক আর কোনো বিরোধী দলই হোক। যার যার দায়িত্ব সে যদি সঠিকভাবে পালন করতে না পারে তাদের অবশ্য অবশ্যই অব্যাহতি দিতে হবে। আর সে অব্যাহতি দেবে দেশের জনগণ। কারণ জনগণই দেশের আসল বা প্রকৃত মালিক। তাই কবিগুরুর কথাতেই বলি—
‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
দয়াহীন সংসারে—
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালবাসো—
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদেরে ব্যর্থ নমস্কারে\
আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপটরাত্রি-ছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে।
আমি যে দেখেছি—প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে\
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে।
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে—
যাহারা তোমায় বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কবিগুরুর অমর ‘প্রশ্ন’ কবিতা আজ সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ন্যায়-সত্যের, ত্যাগ-তিতিক্ষার কোনো বালাই নেই। চারিদিকে স্তাবক আর চাটুকারে ছেয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সবাই দেশটাকে লুটেপুটে খেয়েছে, এখনও খাচ্ছে। কিন্তু যে কৃষক কিছুই না পেয়ে জাতীয় জিডিপির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অবদান রেখেছে, যে শ্রমিক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখেছে তাদের আজ মহাজোট সরকারের মহামন্ত্রীদের কাছে গালমন্দ শুনতে হচ্ছে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী দক্ষিণ অঞ্চলের কন্যা, এক সময় বঙ্গবন্ধুর পিঠের চামড়া দিয়ে জুতো বানাতেন, শেরপুরে বিয়ে না হলে, আওয়ামী লীগের টিকিট না পেলে সংসদ ভবন চিনতেন কি-না বলা যায় না—তিনি আজকাল বলছেন, কৃষকরা এবং গরিবরা সবচেয়ে বেশি অপচয় করে। সুধী সমাজে মন্ত্রী এ কথা উচ্চারণের আগে তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে এল না কেন? আল্লাহর কুদরতে তার কণ্ঠ থেকে জাতির প্রতি এমন অপমানজনক কথা বেরুবার আগে বন্ধ হয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি। বড় মর্ম যাতনার শিকার হচ্ছি এসব কথার প্রতিকার করতে না পেরে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ কিইবা ব্যয় করে আর তা থেকে কতইবা অপব্যয় করবে! আমাদের দেশের নতুন ধনবানরা এক বেলার খাবারে কেউ কেউ হয়তো লাখ টাকা খরচ করে। তারা কোনো অপব্যয় করে না! অপব্যয় করে সেই গরিব মানুষরা যারা ৬-৭ জনে মিলে একবেলায় একশ’ টাকাও জোগাড় করতে পারে না তারা? এমন চেতনার মহিলা মন্ত্রী দিয়ে আর যাই হোক মানুষের কোনো কল্যাণ হতে পারে না। যে গরিব থালা থেকে মাটিতে ভাত পড়লে খুঁটে খায়, জোট সরকারের কাছে তারা আজ খেতাব পেল অপব্যয়ী। আর যে ধনবানরা একজনের জন্য একশ’ জনের খাবার তৈরি করে প্রতিদিন ডাস্টবিনে ফেলে তারা হচ্ছে মিতব্যয়ী। কী আশ্চর্য ব্যাপার! এসব লাগামহীন কথার জবাব মহাজোটকে উপযুক্ত সময় মহারণেই পেতে হবে। জিয়াউর রহমানের সময় সচিব, এরশাদের মন্ত্রী আবার বর্তমান মহাজোটে মাননীয় অনর্থ মন্ত্রী এককাঠি এগিয়ে বলেছেন, গ্রামের কৃষকরা বড় বেশি বিদ্যুত্ অপচয় করে। কী বিচারবোধ! পুরো একটা গ্রামে ১০টা পাওয়ার পাম্পে যে বিদ্যুতের প্রয়োজন তার চেয়ে একশ’ গুণ বেশি বিদ্যুত্ বড় বড় ভুঁড়িওয়ালাদের এক অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে খরচ হয়। তারপরও প্রবাদের মতো, ঝাঁজর বা চালুন বলে সুইয়ের পাছা ট্যারা। মুড়ি ভাজার ঝাঁজর বা চালুন কিংবা ছাকনি যেটার পাছায় হাজারও ছিদ্র সে যদি বলে সুইয়ের পাছা ট্যারা বা ছিদ্র, তাহলে যেমন শোনায়, মাননীয় মন্ত্রীর এ মন্তব্যও ঠিক তেমনই শুনিয়েছে। কোনো বিবেকবান বিচারবোধসম্পন্ন মানুষ এমন মন্তব্য করতে পারেন না। আওয়ামী লীগের নামে কেউ এমন গণবিরোধী মনোভাব পোষণ করতে পারে—এটা ছিল সাধারণ মানুষের কল্পনারও অতীত। এমন মানসিকতা তো মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জননেতা শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লালন-পালন করা আওয়ামী রাজনীতির মানসিকতা হতে পারে না। এসব পণ্ডিতরা এক সময় বাম রাজনীতিতে শরিক ছিলেন। তাই বড় বিস্ময় জাগে কী করে তারা এতদিন এমন গণবিরোধী মনোভাব পুষে রেখেছিলেন। বাম ঘরানার দু’চারজন খ্যাতিমান রাজনীতিককে এই কয়েক বছর আগেও গার্মেন্টের মহিলা শ্রমিকদের মাতারি বলে ব্যঙ্গ করতে দেখেছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এদের যে কী ধাতুতে গড়েছেন তা তিনিই জানেন। প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট হয়েছে। অথচ শতকরা ৯০ জন সাধারণ মানুষ মুহিত সাহেবদের বাজেট নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাজারে চালের, ডালের, তেলের, নুনের দাম কত সেটা নিয়েই তারা বেশি চিন্তিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকলে সাধারণ মানুষ খুশি। ক্রয় ক্ষমতার বাইরে গেলে মহাসুন্দর বাজেটও তাদের হৃদয় স্পর্শ করে না। বাড়ির কাছে রাস্তাটা হলে তারা মনে করে দেশে উন্নতি হয়েছে। কাপড় ভিজিয়ে পারাপার হওয়া খালে কালভার্ট হলে তারা ভাবে দেশে উন্নতি হয়েছে। চোখে দেখার মতো কোনো পরিবর্তন না হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের উন্নতির কথা যতই বলা হোক তারা তা গ্রহণ করবে না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যেখানে কোনকিছুই হয়নি সেখানেই কেউ কেউ বলবেন, অনেক কিছু হয়েছে। চোখ-কান বুজে, বালুর মধ্যে ঠোঁট লুকিয়ে কাকের মতো সব কিছু অস্বীকারের কেমন যেন মারাত্মক রোগে পেয়েছে। কেউ কারও সীমায় থাকতে চায় না। কেউ কারও পজিশনে সন্তুষ্ট নয়। আরও আরও চাই, বড় বেশি করে চাই। এ যেন এক হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীর দেশ। ক’দিন আগে সংসদ সদস্যরা একজন প্রথিতযশা বরেণ্য ব্যক্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সমালোচনায় সংসদ ফাটিয়ে ফেলার অবস্থা করলেন। এ যেন নাই কাজ তাই খৈ ভাজের মতো। আমি বহু বছর যাবত্ যে কথা বলে চলেছি সেদিন হঠাত্ জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সে কথাটাই দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন। সরকার এবং বিরোধী দল নামে দুটি কিন্তু কার্যকরণে তারা এক ও অভিন্ন। এ উপলব্ধির জন্য তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে চাই। ইদানীং আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা তাত্ক্ষণিক সুবিধার আশায় বেশি সংখ্যক বুদ্ধিমান সত্য কথা বলেন না। যখন যা বললে সুবিধা হবে তাই বলেন। এই ক্ষেত্রে মনে হয় এই প্রথম একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। তাকে আবারও অকুতোভয় দেশবাসীর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
সেদিন হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি জনাব এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচার আসনে বসে যে ক্ষুব্ধতার পরিচয় দিয়েছেন— অমন গরম মেজাজের কাউকে অন্তত হাইকোর্টের বিচারপতি করা যায় না। অমন মাথা গরম থাকলে তার কাছ থেকে কারও ন্যায় বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। জনাব এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সম্পর্কে তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তাকে বিচারপতি বানানোর সময় কোনো পরীক্ষাও নেয়া হয়নি। কারণ তিনি আওয়ামী ঘরানার বা পছন্দের লোক। এরই মধ্যে তিনি বহু মানুষকে তার কোর্টে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই অপমান করেছেন। বিচারক হলো আল্লাহর প্রতিনিধি। এ জগত্-সংসারে কত কর্ম আছে কিন্তু বিচারকের আসন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যিনি বিচারকের আসনে বসেন তাকে স্রষ্টার কথা মনে রাখতে হয়। আল্লাহর কথা মনে করতে হয়। রাগ-অনুরাগের তার সুযোগ কোথায়? সবই তো আইন এবং বিবেকের কাছে বন্দী। ক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত হয়ে ন্যায় করবেন কীভাবে? শোনা যায় রেলের কর্মচারীদের তিনি বকাঝকা করেছেন; বিমানের এক শ্রেণীর টিকিট কেটে আরেক শ্রেণীতে ভ্রমণ করেছেন। নিজে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে এর ওর নামে নিজের কোর্টেই মামলা করেছেন—এ কি করে হয়? নিজেই বাদী, নিজেই তদন্তকারী, নিজেই বিচারক? এ তো হওয়ার নয়। ন্যায় ও সত্য এটাকে অনুমোদন করে না। কিন্তু তাই হয়ে এসেছে এতকাল। তাই প্রবীণ আইনজীবী সাহসী মানুষ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক যথার্থই বলেছেন, এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর আল্লাহর বিচার শুরু হয়েছে। আমাদের সংসদের মাননীয় স্পিকার বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ। তার ভাব ও ভাষায় বিস্তর আঞ্চলিক প্রভাব আছে। তিনি অবলীলায় আঞ্চলিক ভাব নিয়েই গর্ব ভরে কথা বলেন। কখনও কোনো হীনমন্যতায় ভোগেন না। কখনও সখনও তিনি দু’চারটি খাপছাড়া কথাও বলেন। এই কিছুদিন আগে বিরোধী দল ওয়াকআউট করায় প্রচণ্ড উত্তেজিতভাবে বিরোধী দল ও তাদের নেতা সম্পর্কে অনেক শক্ত শক্ত কথা বলেছেন। যেটা সংসদের অভিভাবক হিসেবে স্পিকারের মুখে বেমানান। কিন্তু তবু তিনি বলেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে সড়ক ভবনের মামলা নিয়ে সংসদ সদস্যদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রথম তিনি খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন, কোনো আদালত যদি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় তাহলে জনগণ আদালতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। সরকারও যদি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এটাই তো সত্য, খোদার দুনিয়ায় জনগণ পারে না এমন কী আছে? আইন করে পাকিস্তান থেকে আমরা বাংলাদেশ করিনি। জনগণ চেয়েছে রক্ত ঢেলে পাকিস্তানের সমস্ত আইন-কানুন ডুবিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। আল্লাহর পর জনগণই দেশের আসল মালিক-মোক্তার এটা সবাইকে বুঝতে হবে। না বুঝলে মাঝেমধ্যে যা হয় তাই হবে। এর কোনো নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। একজন বর্ষীয়ান জননেতা হিসেবে সংসদের স্পিকার জনাব আবদুল হামিদ জাতির অনুভূতিকে ব্যক্ত করেছেন। এ জন্য যেখানে তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য, সেখানে একজন বিচারক এজলাসে বসে মাননীয় স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। কেউ অপ্রকৃতিস্থ না হলে সংসদের কথা নিয়ে স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলতে পারেন না। সংসদে বলা কথা চ্যালেঞ্জ করার কোনো এখতিয়ার কারও নেই। আর বিশেষ করে আইনের দ্বারা যাদের হাত পা বাঁধা তাদের কেউ যদি নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের বিচার আসনে বসে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেন অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। বিচারালয় কাব্য করার জায়গা নয়, বিচারালয় ন্যায় বিচার করার স্থান। সেখানে বলার চাইতে লেখার দরকার বেশি। সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে, বিচারকের শপথ ভঙ্গ করে কেউ যদি বিচারের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড সংক্রমিত ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের রাজধানীর মহাখালীতে একটি মাত্র কলেরা হাসপাতাল। ফলে এই ভয়াবহ রোগ ছড়িয়ে পড়লে কাউকে বাঁচানো কঠিন হবে। তাই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আগেই রুখে দাঁড়ানো উচিত। সরকার এখানে সরকারের মতো আচরণ করছে না। তাই জনগণকেই দেশের মালিকানা প্রমাণ করার জন্য সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আর এভাবে কাউকে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে দেয়া যায় না। সে সরকারই হোক আর কোনো বিরোধী দলই হোক। যার যার দায়িত্ব সে যদি সঠিকভাবে পালন করতে না পারে তাদের অবশ্য অবশ্যই অব্যাহতি দিতে হবে। আর সে অব্যাহতি দেবে দেশের জনগণ। কারণ জনগণই দেশের আসল বা প্রকৃত মালিক। তাই কবিগুরুর কথাতেই বলি—
‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন