বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বহীন ভাষণ


বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম




নতুন বছর ভালো যাবে—এমনটা সবাই চায়। নতুন বছরের প্রথমেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একটু দেরি করে ১১ জানুয়ারি তিনি তার সালতামামি জাতির উদ্দেশে উপস্থাপন করেছেন। চারদিকে সমস্যাক্রান্ত একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হিসেবে তার ভাষণে যতটা জাতীয় গুরুত্ব পাওয়ার কথা, তাকে যতটা ধীরস্থির-উদ্বিগ্ন থাকা দরকার, তার কিছুই লক্ষ্য করা যায়নি। সভা-সমাবেশে তিনি যে রঙে-ঢঙে কথা বলেন বরং সেদিন তারচেয়েও শক্তভাবে তিনি তার ভাষণ দিয়েছেন। বহুদিন পর তার ভাষণ শুনে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার জাতির উদ্দেশে ভাষণের একই সুর-তাল-লয় কানে বাজছিল। তার ভাষণে তিনি কোনো জাতীয় সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত করেননি। হয় জাতি তার কাছে কোনো কিছুই নয় অথবা খুবই সুকৌশলে সংঘাত জিইয়ে রাখার জন্য সমস্যাগুলোর সমাধানের সামান্যতম আভাসও দেননি। ক্ষমতার গরমে বেসামাল পতিত শাসকদের অতীতের কীর্তিকলাপ যখন যেখানে যা দেখা গেছে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চাল-চলনে-বলনে কোনো পার্থক্য নেই। দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে—এসবই দলীয় স্বার্থে সৃষ্টি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবার সমর্থন চেয়েছেন, ভোট চেয়েছেন। নির্বাচনী আইনে সব প্রার্থীর একই সমান সুযোগ পাওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রচারযন্ত্রে বা অর্থে ভোটের ক্যানভাস করতে পারেন না। বর্তমান নীতিমালা অনুসারে এটা বিশুদ্ধ নয়। কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ফেরাবে কে? একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি তাকে বুঝ দেন, তা না হলে তাকে বোঝাবার ক্ষমতা এ জগতসংসারে যে কারও নেই—এটা তিনি এরই মধ্যে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংবিধানের লেখা অনুসারে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু জনগণের সে কি দুর্ভাগ্য—দেশের প্রধান সেবক মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন কোথাও যান, মালিকদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ, চলাফেরা বন্ধ, রাস্তাঘাট বন্ধ। সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এদিক-সেদিক যান, দু’ঘণ্টা আগে থেকে সব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। লোকজন বলাবলি করে—ঢাকা শহরের অর্ধেক যানজটের কারণ নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। জানি না জনগণের ভোটে, জনগণের সেবায় নিয়োজিত একজন প্রধানমন্ত্রীর চলাফেরার সময় এভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাখা কতটা সংবিধানসম্মত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তায় মনে হয় তিনি সবকিছুই জানেন। তা যদি জানেন, তাহলে তার চলাফেরার সময় প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা আগে থেকে রাস্তা বন্ধ থাকে—তা কি তিনি জানে না? তিনি যেদিক যান, সেদিকে তো বিড়ম্বনার শেষ নেই-ই। লিঙ্ক রোডগুলোর মুখ বন্ধ থাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরও দু’তিন ঘণ্টা ভোগান্তি ভুগতে হয়। ঘ্যাগের ওপর তারাবাত্তি’র মতো বছরখানেক তো হলো মিরপুর রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের (গণভবন) আশপাশ দিয়ে রাত ১১টার পর সব গাড়ি চলাচল বন্ধ। দেশের মালিক চলতে পারে না সেবকের বাড়ির কাছ দিয়ে, রাস্তা বন্ধ! প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান কার্যকলাপ দেখে আমার পুরনো দু’একটি কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজের সামনে ছিল কালিদাস রায়দের বাড়ি। যে বাড়িতে আমার স্ত্রী নাসরীনের জন্ম হয়েছে। কালিদাস রায়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক, পরাক্রমশালী জমিদার। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ সাইকেলে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারত না, ছাতা মাথায় দিতে পারত না আভিজাত্যের কারণে। কিন্তু সেই জমিদারের বংশধরদের করুণ দুর্দিন আমি দেখেছি। বেশি দূরে যেতে হবে কেন? ১৯৫০-৫৫ সালের দিকেও শত শত কোটি টাকার মালিক রণদা প্রসাদ সাহা করটিয়া জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে গাড়িতে চড়ে যেতে পারতেন না। করটিয়া বাজারের কাছে এসে কিছুদূর পায়ে হেঁটে তারপর আবার গাড়িতে উঠতেন। ছোটবেলায় কারণ বুঝতাম না। বুদ্ধি হলে বুঝলাম রণদা প্রসাদ সাহা নিম্ন জাতি ও এক সময় গরিব ছিলেন। আর করটিয়ার জমিদাররা সম্ভ্রান্ত, তাই তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গাড়িতে করে যাওয়া যাবে না! বর্তমানে রণদা প্রসাদ সাহারও সেই জৌলুস, সেই খ্যাতি নেই। কিন্তু দানবীর মানবহিতৈষী করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর অযোগ্য বংশধরদের দেখলে শিউরে উঠতে হয়। তাদের এখন করুণ দশার শেষ নেই। দু’একজন যারা লেখাপড়া শিখেছেন, তারা অন্যের দুয়ারে চাকরি করে খান; জমিদারি চলে না, মর্যাদাবোধও নেই।
যা বলছিলাম, তাই বলি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দক্ষিণে বিশাল ক্রিসেন্ট রোড ১১টার পর বন্ধ। পশ্চিমে গা ঘেঁষে মিরপুর রোড। ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার একমাত্র সড়ক। বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারলেও গাবতলী থেকে আড়ং বা মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত পৌঁছতে কখনও আধঘণ্টা, কখনও দু’ঘণ্টার প্রয়োজন। দূরত্ব বড়জোর দু’তিন কিলোমিটার। সেখানে ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো রাত ১১টায় দুমুখী রাস্তার এক মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। মিরপুর থেকে ঢাকার দিকে যেই মাত্র সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়, সেই মাত্র মহাযানজটের কারণ ঘটে। ঢাকার দিক থেকে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ি শ্যামলীর কাছে স্বাচ্ছন্দ্যে পার হতে না পেরে দিন-রাত এক যানজটের সৃষ্টি হয়। তার ওপর রাত ১১টায় যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছাকাছি এলে দক্ষিণ দিকে বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন এক অমানবিক দুর্যোগের কারণ ঘটে। রাতে সৃষ্টি হওয়া যানজট সকালেও শেষ হয় না। কত রোগী ঢাকার দিকে যাওয়ার পথে রাস্তায় আটকে পড়ে মারা যায়। আবার কত লাশ ঢাকা থেকে গ্রামে নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কারণে সৃষ্ট যানজটে বাড়ি পৌঁছতে পারে না। ১২ জানুয়ারি সখীপুরের বাঘবেড়ে এক জনসভা করতে গিয়েছিলাম। বিপুল লোকের সমাগম হয়েছিল সে সভায়। তবে সখীপুর এবং অন্যান্য স্থানে জনসভায় যে পরিমাণ মেয়েরা আসত, তত মহিলার সমাগম হয়নি। হয় আমাদের আকর্ষণ নষ্ট হয়ে গেছে, না হয় কর্মীরা মহিলাদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারছে না কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গ্রাম-গঞ্জের মা-বোনরা দেশের প্রতি, দেশের কথা শোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সখীপুরের বাঘবেড় থেকে রওনা হয়েছিলাম ৫টা ১০ মিনিটে। ৭টা ৫০ মিনিটে উল্টো পাশ দিয়ে আমিনবাজার মসজিদের কাছাকাছি এসেছিলাম। সামনে বিকল গাড়ি থাকায় এমন এক বিশ্রী অবস্থায় পড়েছিলাম; ১ ঘণ্টায় ১ ইঞ্চিও আগপিছ হতে পারিনি। পুরনো ড্রাইভার শাহ আলম হঠাত্ বলল—পেছনে খালি হয়েছে, আমরা কি ঘুরে আবার ওই লেনে যাব। আল্লাহর অশেষ দয়ায় গাড়ি ঘুরিয়ে আবার এক-দুই কিলোমিটার সাভারের দিকে গিয়ে রাইট ট্র্যাকে এসেছিলাম। প্রচণ্ড ভিড়; গাড়ি এগুচ্ছিল না। হঠাত্ এক মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত নাসিরের কথা মনে হলো। ওর এক ভাই যুদ্ধের সময় খুবই ছোট ছিল। দু’চারবার কোলেও উঠেছে। অনেক বছর সার্জেন্টের চাকরি করেছে। হঠাত্ করে আমার এক সহকর্মী তাকে ফোন করে কি যেন বলেছিল। এরই মধ্যে ফরিদের ফোন পেলাম, ‘দাদা আপনি কোথায়?’ বললাম, ‘আমিনবাজারে ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।’ অনেক বছর ঢাকার ট্রাফিক কন্ট্রোল আমাদের রাস্তা দেখিয়েছে। ও কি করে যেন ভিআইপি ট্রাফিক কন্ট্রোলের ডিসি-এডিসিকে ফোন করেছিল। সব সময়ই দেখছি বিরুদ্ধ মতবাদী ছাড়া সাধারণ কর্মচারী-কর্মকর্তারা সবাই দারুণ সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। তারা নাকি তাকে বলেছেন, যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি দিগন্ত টেলিভিশনে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নেবেন। ওর কয়েক মিনিট পরই গাড়ি চলতে থাকল। কোথাও দ্রুত, কোথাও একটু ধীর কিন্তু এক জায়গায় ছাগলের খুঁটি মেরে আর দাঁড়িয়ে থাকছে না। মিরপুর ব্রিজের ওপরে হঠাত্ এক অপরিচিতের ফোন পেলাম, ‘স্যার আপনি কোথায়?’ বললাম, ‘মিরপুর পুলের ওপর।’ তিনি বললেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা আপনাকে পার করে আনছি।’ মাঝে মাঝে ফোন আসতে থাকল। দু’একবার আমিও করলাম। আমিনবাজার মসজিদের কাছে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। অথচ কন্ট্রোল রুমের সহায়তায় ৪০-৪৫ মিনিটে বিজয়নগরের দিগন্ত টেলিভিশনে পৌঁছে গেলাম। আর ১০ মিনিট দেরি হলে ১২ তারিখ শনিবারের প্রোগ্রামটি করতে পারতাম না। আগে মনে হতো ‘সবার ওপরে দেশ’ বোধ হয় কেউ দেখে না। কিন্তু গত ক’মাস এত চিঠিপত্র, এত ফোন পাই; তাতে বিস্মিত না হয়ে পারি না। তাই প্রোগ্রামটি মিস হলে দর্শক-শ্রোতারা যেমন কষ্ট পেতেন, আমারও খারাপ লাগত। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন ১২ তারিখের অতিথি। তার আবার বাংলা ভিশনে ১২টা কয়েক মিনিটে সরাসরি সম্প্রচার ছিল। তাই তারও তাড়া ছিল। এসব কারণে খুব বিব্রত ছিলাম। আমি সাধারণত সরকারি লোকের সরকারি কাজে খুব একটা খুশি হই না। মনে করি তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু ১২ তারিখে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সহায়তায় দারুণ খুশি হয়েছি। সেজন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, তারা যেন শুধু আমাকে নয়, ছোট-বড়, ধনী-গরিব আমজনতাকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে সাহায্য করে।
সেই সকাল ৮টায় টাঙ্গাইল থেকে বেরিয়েছিলাম। সিলিমপুর-সখীপুর বাঘবেড় হয়ে রাত ১০টায় দিগন্ত টিভিতে গিয়েছিলাম। মিনিট দশেক লেগেছিল বিজয়নগর থেকে অত রাতে আসাদ গেটে আসতে। সেখানে এসেই মারাত্মক জ্বালা—প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা। তখন রাত ১১টা ৩ মিনিট। আসাদ গেট থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট কত আর হবে, পাঁচশ’-ছয়শ’ গজ। এটুকু আসতেই দীর্ঘ ৫০ মিনিট লেগে গেল। বুকের ভেতর হুতাশ উঠেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য আমার জীবনের মনে হয় ৫০ বছর ধ্বংস হয়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা নগর গণভবনের কোথায় থাকেন, অন্যরা না জানলেও আমি জানি। রাস্তা থেকে তার ঘর বহু দূরে। বন্দুকের গুলিও তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছবে না। তাহলে জনগণের নেতা হয়ে এত ভয় কেন? মিরপুর রোডের এক পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে আর ২০-২৫ গজ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে গাড়ি-ঘোড়া চলাচল করলে কি ক্ষতি? পশ্চিমে মিরপুর রাস্তা থেকে তার অফিস এবং শোবার ঘর প্রায় চার-পাঁচশ’ গজ দূরে। আর মাত্র ২৫-৩০ গজ কাছে গিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চললে তার কি এমন ক্ষতি হতে পারে? কিন্তু এ সামান্য বাধায় হাজার হাজার মানুষের শত শত ঘণ্টা কর্মকাল নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণের ক্রিসেন্ট রোড থেকেও তার ঘর ৩০০ গজের কম দূরে নয়। কার ভয়ে, কি কারণে এসব রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? কারা এসব পরামর্শ দিয়েছে? প্রধানমন্ত্রী তা কি আদৌ জানেন? না জেনে থাকলে একটু খোঁজ-খবর করে দেখুন না রাস্তাঘাটে মানুষজন কি সব বলাবলি করে। নিরপেক্ষ কোনো মাধ্যমে তার সামান্য কিছু জানলেও কষ্ট করে আমার এসব অপ্রিয় কথা বলতে হতো না।
গত ২৯ ডিসেম্বর ছিল নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন। বিপুল ভোটে মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়েছিল, তারই চতুর্থ বার্ষিকী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। সবকিছুতেই সাবেকরা বহাল। সরকারি দল, একটা কিছু দেখানো দরকার—দেশবাসীকে তারা তাই দেখিয়েছে। আমাদের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ খুবই ছোট্ট দল। আমাদেরও ওইদিন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। একসময় সবার কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলাম, নাম-ঠিকানাসহ সর্বনিম্ন দশ টাকা। অসংখ্য কর্মী এবং দু’চারজন আগন্তুক নাম-ঠিকানাসহ দশ-বিশ-পঞ্চাশ-শ’-হাজার, এমনকি দশ হাজার টাকাও দিয়েছেন। তারচেয়েও বেশি দেয়া একজন সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘লিডার, এভাবে দশ-বিশ টাকা সহযোগিতা নিয়ে আপনি দল চালাবেন কি করে?’ প্রশ্নটা শুনে বহুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অর্থ সংগ্রহ করত স্বেচ্ছাসেবক ইউনিয়ন কমান্ডাররা। হিসাব ছিল কঠিন। এক টাকা এদিক-ওদিক হলে শাস্তি। সাধারণ মানুষ দু’এক টাকা করে চাঁদা দিত। যারা চাঁদা সংগ্রহ করত, তারা পাগল হয়ে যেত। বিকালে দেখত অর্থের পরিমাণ তিন-চার বা পাঁচ হাজার টাকা। তার জন্য দু’একজনকে হয়তো জবাবদিহিও করতে হতো। এত লোক কিন্তু অর্থ এত কম কেন? আবার কোনো কোনো জায়গায় দেখা যেত ঝামেলাহীন, লোক কম। কিন্তু চাঁদার পরিমাণ বেশুমার। তাই স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডাররাই তাদের বাস্তব জ্ঞানে অল্প কিছুদিন পর থেকে দু’এক টাকা চাঁদা নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দু’চার-পাঁচশ’-হাজার যারা দিতেন, তাই-ই সংগ্রহ করতেন। তাতে ঝামেলা কম, অর্থের পরিমাণ বেশি। এরকম এক সময় জুলাই মাসের প্রথম দিকে আক্কেল আলী সিকদারের নেতৃত্বে কালিয়াকৈরের ১৩০ রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণ দেখার জন্য অনেক লোকসমাগম হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এক-দেড় হাজার তো হবেই। এক সহযোদ্ধা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা অনেক যুদ্ধ করেছে। দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাতে নিজেই গান বেঁধেছে, সুর করে শুনিয়েছে। সে যেন নতুন নতুন স্লোগানের স্রষ্টা। হঠাত্ করেই ‘বঙ্গবীর’ স্লোগান আবিষ্কার করে ফেলে। তাদের কাছে স্লোগানটি ভালো লাগলেও আমি খুব উত্সাহ পাইনি। থামিয়েও রেখেছিলাম অনেকদিন। পরে আর পারিনি। অস্ত্রসহ একদল রাজাকার সারেন্ডার করায় আমরা খুব ফুর্তিতে ছিলাম। সব অনুষ্ঠান শেষে জনতার উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়, হানাদারদের প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা চিত্কার করে বলছিলাম। আমার বক্তৃতার মাঝে একজন সাধারণ মানুষ সভাস্থলে গর্জে উঠেছিল, ‘এই যে কাদের সিদ্দিকী, গরিবের টেহার মুক্তিগোরে দরকার আছে কি নাই? আইজ কইয়া যাওন লাগবো।’ প্রথমে আমি তেমন বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডাররা হিসাবের ভয়ে গরিব মানুষের দু’এক টাকা এখন আর নেয় না। দু’দিন পরই সাইক্লোস্টাইল করে জানিয়ে দেয়া হলো, ইউনিয়ন পরিষদে ট্যাক্স দিলে মুক্তিবাহিনীর তহবিলে জমা হবে। যাদের ট্যাক্স নেই, তারাও এক টাকা থেকে যে কোনো পরিমাণ অর্থ দিতে পারবে। মাত্র বিশ দিনে তিরাশি লাখ টাকা উঠেছিল। আমরা চকিদার, দফাদার, ন্যাশনাল ডাক্তার, ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছিলাম। তাতেও অর্ধেক টাকা বেঁচে গিয়েছিল। যে কারণে স্বাধীনতার পর গ্রাম-গঞ্জে আমার সম্মান ছিল আইয়ুব সরকারের চেয়েও বেশি। আইয়ুব সরকারও চকিদার, দফাদার, ন্যাশনাল ডাক্তার, ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের একবারে বেতন দিতে পারেনি। ১০-১২ বছর বেতন বাকি ছিল। তাই সবাই ভাবত যুদ্ধ করেও আমি সব বেতন দিয়ে দিতে পেরেছি। আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।

রবিবার, ১ জুলাই, ২০১২

স্মৃতিময় ধানগড়া



ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম
২১ মে ‘স্মৃতিময় ধানগড়া’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেন, কীভাবে এক অনাত্মীয়ের বাড়ি ধানগড়াতে গিয়েছিলেন তা লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমসাময়িক কিছু ঘটনার কারণে গত কয়েক পর্বে সেই করুণ কাহিনী আর লেখা হয়নি। পাঠকরা হয়তো মনে করবেন আমি তাদের এক গভীর অন্ধকারে ফেলে দিয়েছি। আসলে দোষ-গুণ যাই বলুন, আমি একজন বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ। শত্রুকেও বিশ্বাস করা আমার স্বভাব। নিজে জেনে-শুনে চোখে দেখে অহেতুক একটা পিঁপড়েও মারার চেষ্টা করিনি কোনোদিন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সখিপুরের নলুয়ায় একদিন আমার গায়ে একটি বড় পিঁপড়ে উঠেছিল। গ্রামে যাকে বলে মাঞ্জাইল। কামড় খুবই শক্ত। নলুয়ার রাসেল আমায় মামা বলে ডাকে। ভারতে নির্বাসনের সময় বহু চিঠি লিখেছে। এখন সে একজন বেশ বড়সড় ভালো স্বভাব কবি। ছুটে এসে মাঞ্জাইলটি মারতে যাচ্ছিল। ছোট বলেই আমার গায়ে হাত লাগাতে সাহস করেছিল। বড়রা তখন বড় বেশি সমীহ করত। আমার গা ছোঁয়া ছিল তাদের জন্য সাত রাজার ধন মানিক পাবার মতো ব্যাপার। ওই ধরনের পিঁপড়ে কামড় দিলে ভীষণ জ্বালা করে, সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ওঠে। তাই সে অত ব্যাকুল হয়ে মাঞ্জাইলটি মারতে চাচ্ছিল। তাকে বলেছিলাম, ওকে মেরো না, আমি ওর কোনো ক্ষতি করিনি, ও-ও আমার ক্ষতি করবে না। আপনাআপনি চলে যাবে। সেদিনও গায়ে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, কালো মুজিব কোট ছিল। কেন জানি কোনো কামড় না দিয়ে সত্যি-সত্যিই পিঁপড়েটি চলে গিয়েছিল। লেখালেখির ব্যাপারে পাঠকরা আজ আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, শত জনমের আরাধ্য ধন। আমার লেখা তাদের পছন্দ, না পছন্দ হতে পারে। আমি ভুল ভাবতে পারি। ভুল লিখতে পারি, ভুল করতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে করে কাউকে বিভ্রান্ত করতে পারি না। চালাকি করতে পারি না।
বংশাই নদীর পাড়ে এক নিরিবিলি ছোট্ট গ্রাম ধানগড়া। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল আড়াই দূরে হবে। কিন্তু ওর আগে কোনোদিন যাইনি। তবে নদীপথে পার্কী, মরিচা, মৈষবাতান, ডাবাইল, রতনগঞ্জ যাওয়ার পথে আগেও দেখেছি। বেশ কয়েকটি আমগাছ আর বাঁশঝাড়ের পাশে বসেছিলাম। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ, ভীষণ বাতাস বইছিল। মন ছিল খুবই ভারাক্রান্ত। তবে ২০-২৫ দিন পর মা-বাবা, ভাই-বোনদের পেয়ে আর মুক্ত বাতাসে বসে থেকে মনের চাপ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর নদীর পাড় থেকে বাড়ি গিয়ে খাবার খেলাম। খুবই সাধারণ খাবার, চামারা চালের ভাত, ভাজি, শাক-সবজি আর ছোট মাছের ঝোল। এখন আর তেমন রান্না হয় না, সে স্বাদ পাওয়া যায় না। ডিজিটাল দেশে স্বাদের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল প্রভাব পড়েছে। মা-বাবা, ভাই-বোন কেন ধানগড়ায় এসেছে। ভাই-বোনদের কাছ থেকে কিছুটা জেনেছিলাম। কিন্তু তাতে তেমন বুঝতে পারিনি। খাবার পর বাবা বললেন সেই করুণ কাহিনী। ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল শহরে হানাদার বাহিনীর প্রবেশের আগ পর্যন্ত গ্রামে তারা রাজ-রাজড়ার মতোই ছিলেন। কিন্তু যেই পাকিস্তান হানাদাররা টাঙ্গাইল প্রবেশ করে বদিউজ্জামান খান এমপি, আসাদুজ্জামান খান ও আমাদের বাড়ি ধ্বংস করে দেয় তখন থেকেই ছাতিহাটি গ্রামে উত্তেজনা শুরু হয়। লতিফ সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকীর বাবা-মা গ্রামে আছে এটা জানলে পাকিস্তান হানাদাররা সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। তাই তাদের গ্রামে না থাকাই ভালো। বাইরের মানুষ হয়তো কথাটা মনে মনে ভেবেছে কিন্তু প্রকাশ করেনি। গ্রামের সবাই সবসময়ই আমাদের ভালোবেসেছে। চরম বিপদে তারা ভয় পেতে পারে। কিন্তু তাতে আমাদের প্রতি মায়া, মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কোনোদিন কমতি হয়নি। সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছিল খুবই ভয়াবহ অস্বাভাবিক। আজকাল সেই সময় অনুধাবন করা বা চিন্তা করা সে যতই মেধাশীল হৃদয়বান হোক প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ পৃথিবীর কোথাও হয়তো এর আগে আর কখনও অমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি। এখন যখন তখন কোথাও কিছু হলেই কেউ কেউ বলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চাইতেও খারাপ হয়েছে। তখন তাদের প্রতি বড় বেশি ঘৃণা জাগে। মুক্তিযুদ্ধকে তারা এত সস্তা করে ফেলতে কেন চেষ্টা করেছেন, ভাবলেই অবাক লাগে। গ্রামের বাড়িতে আমাদের নিজেদের কোনো ঘর ছিল না। আমাদের বিরাট পুব দুয়ারী ঘর ’৫৮-’৬০ সালে এক মারাত্মক ঝড়ে ভেঙে গিয়েছিল। গ্রামে কেউ থাকতাম না বলে আমাদের ভিটায় আর ঘর তোলা হয়নি। কিন্তু ’৭১-এর মার্চে বাবা পরিবার-পরিজন নিয়ে যখন গ্রামে যান তখন অবশ্যই নিজেদের ঘর থাকলে কথা হতো এক রকম, বাপ-দাদার ভিটায় নিজেদের ঘর ছিল না বলে ঘটনা ঘটেছিল অন্য রকম। আমাদের ঘর না থাকলেও তখনও বাড়িতে বিরাট বিরাট ৩-৪টি ঘর ছিল। বরং থাকার মানুষই কম ছিল। কদাচিত্ গ্রামে গেলে আমরা মাঐ মা’র ঘরে থাকতাম। আমি আমার বাবার মা দাদীকে দেখিনি। কিন্তু বাবার বাবার মা মানে মাঐ মা’কে দেখেছি। শিশুকালে তিনিই ছিলেন আমার সব বিপদ আপদের আশ্রয়স্থল। তাঁর মস্তবড় ঘরে আমরা থাকতাম। সিদ্দিকী পরিবারে আমার মাঐ মা ছিলেন সব থেকে সম্পদশালী। তাঁর অনেক জমি-জমা, টাকা-পয়সা ছিল। ষাটের দশকে তিনি মারা গেলে তাঁর ঘর বাবা নিজের ঘরের মতোই ব্যবহার করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ঘরেই বাবা-মা উঠেছিলেন। তখন প্রতিদিনই গ্রামে নতুন নতুন খবর যেত, রাস্তাঘাটে কত মানুষ মেরেছে তার খবর, কত ঘর-দুয়ার পুড়েছে তার খবর, স্বাধীনতার পক্ষের কাকে কোথায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে তার খবর। আসলে মানুষের কোনো স্বস্তি ছিল না। চারদিকে ভয় আর ভয়। ভয়ে ভয়ে মানুষ ছিল জড়সড়। মনে হয় ১০-১২ তারিখের পর গ্রামের পরিবেশ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আমাদের বাড়ির পাশেই আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারদের বাড়ি। তারা কেউ বাড়িতে ছিল না। সে বাড়িতে ওয়্যারলেস ছিল। সেট ওপেন করলেই নানা দিকের খবর আসত। মানুষ তাতে আরও শঙ্কিত হতো। মনে হয় ১৪-১৫ তারিখের দিকে ছোট চাচা একেবারে অধৈর্য হয়ে পড়েন। বাবা আর একদিন গ্রামে থাকুক তা তিনি চাচ্ছিলেন না। আকার-ইঙ্গিতে দু’চারবার বলেছেন। কিন্তু কোথায় যাবেন, কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বাবা তখন বড়ই অসহায়। এমনিতে তাঁর মতো সাহসী মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছি। কিন্তু তারপরও নিজের পরিবার পরিজনের জন্য সবারই কমবেশি দুর্বলতা থাকে। খুব সম্ভবত ১৫ তারিখ দুপুরের দিকে আর্মি আসতে পারে খবর পেয়ে ছোট চাচা একেবারে উন্মাদ হয়ে যান। বাবাকে বলেন, এখনই আপনারা গ্রাম ছেড়ে চলে যান। আপনারা থাকলে আপনাদের খোঁজে আর্মি এসে আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। আরজু, বজ্রের জন্য আমরা আমাদের বাড়িঘর জ্বালাতে-পোড়াতে পারব না। শুধু কথায়ই নয়, কাজেও তা প্রমাণ করতে শুরু করেন। বাবা-মা’র বাক্স, ড্যাকস, পোঁটলা-পুঁটলি উঠানে ফেলে দেন। মা অবাক বিস্ময়ে ছোট দেবরের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকেন। কারণ ছোট চাচা আমাদের টাঙ্গাইলের বাসায় থেকে সারাজীবন পড়াশোনা করেছেন। মা-বাবা তাকে সবসময় সন্তানের মতোই দেখতেন। জিনিসপত্র ফেলে দিতে দেখে ভাই-বোনেরা কান্না জুড়ে দেয়। ধানগড়া থেকে আমাদের খোঁজে আসা নাজির, সিরাজ, হামিদ এবং নাজির হোসেন নাদুর ছেলে শাহজাহান ভেবাচেকা খেয়ে যায়। একসময়ে তারা ফেলে দেয়া পোঁটলা-পুঁটলি কাঁধে তুলে বাবা-মাকে বলে, চাচা মিয়া, চাচী বিবি আমরা গরিব মানুষ, আমাদের তেমন বাড়ি-ঘর নেই, তাই পোড়ার ভয়ডরও নেই। চলেন আমাদের বাড়ি। যেভাবে পারি সেভাবে রাখব। সত্যিই তারা তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের সেই দুঃসময়ে আশ্রয় দেয়ার ঋণ আমরা কে কতটা শোধ করেছি বা করতে পেরেছি। আমাদের কৃতজ্ঞতার বড়ই অভাব। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার বিরাট বিরাট ধনী, বিদ্বান, বুদ্ধিমানরা গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক বড় হয়েছেন। অঢেল বিত্তবৈভব হয়েছে। তারা অনেকেই দুঃসময়ের সেই আশ্রয়দাতাদের আর চিনতে পারেনি। সম্মান দেখাননি, খোঁজ-খবরও নেননি। আমি স্পর্শকাতর একজন মানুষ। আমি আমার পরিবার-পরিজনদেরই যে আচরণ দেখেছি বা এখনও দেখছি তাতে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। অন্যের কথা আর কি বলব? ১৬ আগস্ট ধলাপাড়ার মাকড়াইয়ে সম্মুখ যুদ্ধে হাতে-পায়ে গুলি লেগে গুরুতর আহত হলে আমার পরিবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। রহিমা, শুশুমা, শাহানা, মুরাদ, আজাদকে নিয়ে মা আসেন ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। বাবুল, বেল্লাল এবং বাবাকে নিয়ে আমি যাই সীমান্তের দিকে। সেখানে বেল্লালই সব থেকে ছোট, তার দশ-এগারো বছর বয়স ছিল। জামালপুর, নরন্দির পর সে আর হাঁটতে পারেনি। কমান্ডার মনিরুল ইসলাম, হুমায়ুন বাঙাল, আবুল কাশেম ও সাইদুর তাকে প্রায় চল্লিশ মাইল কাঁধে করে ভারত সীমান্ত পার করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই বেল্লালকে তাদের প্রতি যতটা কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা ছিল তা দেখিনি। এখন ওরা কেউ লন্ডন, কেউ আমেরিকা, কেউ আবার কানাডায় থাকে। এখন তো কেউ কাউকে চিনবেই না। ধানগড়া এবং সুরিরচালা মিলে ওরা প্রায় ৫ মাস ছিল। ধানগড়ায় যেমন নাজির, সুরিরচালায় আবু সাইদ চৌধুরীর খামার বাড়িতে মৈশাল, ফরহাদ যারা ওদের দেখাশোনা করেছে তাদের কাউকেই বাবা-মা ছাড়া আর কেউ যথাযথ সম্মান করেনি। বাবা বড় কঠিন মানুষ ছিলেন। ’৯০-এর পর নাজির কিংবা হামিদ অথবা মৈশাল এলে বলতেন, আমরা মারা গেলে তোমাদের আর কেউ খবর নেবে না। বজ্র যতদিন আছে ততদিন ওর কাছে যেতে পারবে। তারপর না তোমরা ছায়া পবে, না তোমাদের ছেলেমেয়েরা পাবে। বাবা-মা’র কথাই সত্য হয়েছে। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের প্রথম সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে ছিলেন। এখানকার দুঃখ-কষ্ট, দৈনিন্দ্য কিছুই দেখেননি। বাবা-মা, ভাই-বোনদের যারা সে সময় সাহায্য করেছেন তাদের একজনেরও কোনো খোঁজ-খবর কখনও নেননি। এখনও গা করেন না। মেনে নিলাম বড় ভাই দুঃসময়ে ছিলেন না, তাই গা করেন না। কিন্তু যারা ছিল রহিমা, শুশুমা, শাহানা, বাবুল, বেল্লাল, মুরাদ, আজাদ তারা? ওদেরকে তো খেতে দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে, ওদের বোঝা অন্যে বয়ে বেরিয়েছে। এখন তো নিজের চোখেই দেখি, সুরিরচালার মৈশাল যখন আসে আমার ভাই-বোনরা কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে না। রহিমা রেডক্রিসেন্টে বেশ বড় চাকরি করে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়। মাঝে-মধ্যেই দেশে আসে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ওকে একবারও সুরিরচালা বা ধানগড়ার কথা বলতে শুনিনি। এই তো কয়েক মাস হলো সেলিনা খান শুশুর ছেলের বৌ-ভাত হলো। কতজনকে দাওয়াত করল, কতজনকে হলুদের জন্য শাড়ি দিল কিন্তু একবারও ধানগড়ার নাজিরদের কথা, সিরাজদের কথা, হামিদদের কথা মুখে আনল না। প্রায় একনাগাড়ে ওরা ৪ মাস সুরিরচালায় ছিল। সেখানকার কথা এখন হয়তো ওদের মনেই হয় না। ঠিক আছে, ওরা না হয় দেশে থাকে না। আজাদ, মুরাদ, বাবুল ওরা তো থাকে। সবাই বড় হয়েছে। ওরা তো কেউ কোনোদিন আশ্রয়দাতাদের কথা সম্মানের সঙ্গে মনে করে না। যেমনটা আজকাল দেশের বিত্তবানরা, নেতা-অভিনেতারা, যারা দেশ বানিয়েছে সেই দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বিন্দুবিসর্গও মনে করে না। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় হয়েছে মনে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিড়ম্বনার এক কারখানা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কিছু কিছু লোকের আখের গোছানোর একটা সুযোগ। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট মর্জিমত নিজের কল্যাণ নিয়েই ব্যস্ত। এই রকম অবস্থায় কোনো জাতি কখনও এগুতে পারে না। আর কৃতজ্ঞতাবোধহীন কেউ তো মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। মনে হয় তাই আজ আমাদের মাঝে এমন চরম অশান্তি। বুঝতে পারছি স্মৃতিময় ধানগড়া থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছি। ইচ্ছে ছিল ঐদিনই দূরে কোথাও চলে যাব। কারণ পাকিস্তান হানাদাররা হন্যে হয়ে খুঁজছিল আমাকে, পুরস্কার ঘোষণা করেছিল লক্ষ টাকা। আমি ধানগড়ায় আছি সে খবর পৌঁছলে আর্মিরা সেদিকে আসতে পারে, তাই থাকতে চাইনি। কিন্তু ছোট ভাই-বোনদের পীড়াপীড়িতে ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ আমাকে ধানগড়াতেই থাকতে হলো। ওই গ্রামের কে যেন একটা থ্রি-ব্র্যান্ডের রেডিও-কাম টেপরেকর্ডার এনেছিল। হিতাচী টেপরেকর্ডার। সেই ছেলেবেলা থেকে গানের পোকা ছিলাম। লোকটি টেপরেকর্ডার বিক্রি করবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক’টাকা হলে বেচবে?’ ‘৭০০ টাকা।’ বললাম, ‘৬০০ টাকায় দেবে?’ প্রথম প্রথম রাজি হলো না। বিকালে ৬২৫ টাকায় টেপটি আমাকে দিয়ে গেল। হয়তো ওই টাকায় বেচতো না কিন্তু ক্যাসেট কভারটি ভাঙা থাকায় দেখতে ভালো ছিল না। খুঁত ছিল বলেই হয়তো সেটি আমার কাছে বেচেছিল। থ্রি-ব্র্যান্ডে রেডিওসহ ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা, ৭-৮ ইঞ্চি উঁচু হিতাচী টেপরেকর্ডার ঢাকাতে ৭০০-৮০০ টাকাতেই পাওয়া যেত। আর তখনকার সময়ে ৭০০-৮০০ টাকায় গ্রামগঞ্জের দুই পাখি জমি কেনা যেত। যা এখন কম করেও ১৪-১৫ লাখ টাকা। সে যাক, অর্থনীতি বদলে গেছে। আয়-ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। কবে আবার বিশ্বময় অর্থনীতির একটা স্থিতিশীলতা আসবে বলা যায় না। টাঙ্গাইল সংগ্রাম পরিষদের দেয়া হাজার তিনেক টাকা তখনও আমার কাছে ছিল। যত চেষ্টাই করি দু’জনে সারাদিনে ২-৩ টাকার বেশি খরচ করার উপায় ছিল না। তাই ধানগড়া গিয়েই মা’কে এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ১০০ টাকার নোটগুলো ছোট করে নিও। কারণ পাকিস্তান সরকার বড় টাকা বাতিল করে দিতে পারে। এমনিতেই মা’র রান্না ছিল অমৃত। মা মা’ই, মা’র কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমি মা’কে হারিয়ে বড় কষ্টে আছি। সেই খাবার আর পাই না, জীবনে কোনোদিন আর পাবও না। অনেক কিছু না পাওয়া মানুষ আমি, তারপরও আমার কাছে মা’র রান্না খাবার ছিল দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। দুপুরে এবং রাতে বড় ভালো করে তৃপ্তিসহকারে খেয়েছিলাম। গরিব বাড়ি হলেও খাওয়ার আয়োজনে কোনো কমতি ছিল না। ৫-৬ টাকার বাজার করলে ৫০ জন খাওয়া যেত। রাতের খাবার খেয়ে অনেক গল্পগুজব করে পাশের মোস্তফা কামালের ঘরে শুতে গিয়েছিলাম। মোস্তফা কামাল আমায় নানা বলে ডাকে। ওর সে সময় জন্ম হয়েছিল কিনা জানি না। এখন সৌদি আরবে থাকে। একজন স্বভাব কবি। কিন্তু ’৭১-এর ১৮ এপ্রিলের রাত ওদের ঘরে কাটাতে পারিনি। ১২ কিংবা ১টার দিকে কয়েকজন এসে হাজির। ব্যাপার কি? কালিহাতী মুক্তিবাহিনী এসেছে। তাই লতিফ ভাই উপলদিয়ার ফজলু, রতনপুরের ফারুক আর পাকুটিয়ার মংলাকে আমার খোঁজে পাঠিয়েছেন। আর থাকি কী করে? প্রায় ১৫ দিন বড় ভাইকে তীর্থের কাকের মতো খুঁজছি। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো তিনি এসে গেছেন। ওর চাইতে বড় পুরস্কার আমার জন্য তখন আর কী হতে পারে। তখনই ছুটলাম কালিহাতী। ধানগড়া থেকে কালিহাতী ৮ মাইল। রাস্তাঘাট ভালো না। তাই পথ ফুরাতে চায় না। কামার্তিতে আসতে আসতেই ফজরের আজান হয়ে গেল। সাইদুরদের বাড়ি উঠলাম। সাইদুর এবং তার ছোট ভাই সাত্তার বাড়ি ছিল না। ওরা আগেই কালিহাতী চলে গেছে। কারণ তখন আমাদের সবার নেতাই লতিফ সিদ্দিকী। লাল মিয়ার খোঁজ করলাম। সেও নেই। সাইদুর আর আমি করটিয়া কলেজে একসঙ্গে পড়তাম। ছাত্র রাজনীতিও করতাম একসঙ্গে। আমাদের সময় আমাদের বন্ধু-বান্ধবের মা-বাবারা নিজের মা-বাবার মতোই আচরণ করতেন। সাইদুর না থাকলেও ওর মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই ছুটে এলো। হাত-মুখ ধোয়ার পানি দিল। আমরা ছিলাম ৪ জন। খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি দিল। তৃপ্তিসহকারে খেয়ে এলাম কালিহাতীতে। তখন ছয়-সাড়ে ছয়টা বাজে। ৭টার দিকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হলো। দেখলাম ৩ এপ্রিল সাটিয়াচরা, নাটিয়াপাড়া থেকে যে ইপিআররা পিছিয়ে এসেছিল ওটা তাদেরই একটা অংশ। (চলবে)

রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

জীবন যেন এক বহতা নদী



ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম
সেই চল্লিশের দশকে এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্মেছিলাম। দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে জীবনের শেষের দিকে রাজধানীতে বসবাস করছি। কীভাবে যে সেই ছোট্ট শিশুটি এত তাড়াতাড়ি শেষেরদিকে চলে এলাম বুঝতেই পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখতাম ৬০ বছরেই মানুষ কেমন যেন বৃদ্ধ, অসহায়। কিন্তু এখন আগের মতো অত শারীরিকভাবে কেউই অসমর্থ হয়ে পড়ে না। বছর পেরিয়ে যাচ্ছে আমার দেশ’এ নিয়মিত লিখি। অন্য কয়েকটি পত্রিকাতেও লেখালেখি করি। এজন্য সময়ের যে খুব একটা অভাব হয় তেমন নয়। গত পর্বে মহামহিম প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে লিখেছিলাম। ১৮ তারিখ রাতে তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বড় ভালো লাগল কথা বলে। আমাদের দেশের হঠাত্ বাবুরা সামান্য কিছু হলেই ধরাকে সরাজ্ঞান করে। কিন্তু তাদের মধ্যে ওসব নেই। প্রদ্যুত্ গুহ ফোন ধরতেই বললেন, ‘বাঘা দা, দাদার সাথে কথা বলুন।’ মহামহিম প্রণব মুখার্জি ফোন ধরেই বললেন, ‘অভিনন্দন বার্তা পেয়েছি। তোমরা কেমন আছো, ছেলেমেয়ে কেমন আছে?’ সেই আগের মতো আগ্রহ, আগের মতোই কথাবার্তায় কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু আমাদের কেমন যেন রোগে ধরেছে। পদ না থাকলে রাস্তায় ঘোস পারে, পদ পেলে আসমান দিয়ে হাঁটে। যাক ওসব। ২৫ জুন ১৯৮৪, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ৪৬, সদরঘাট রোডের বাড়িতে আমার বিয়ে হয়। সে এক অভিনব বিয়ে। ৭ ভরি সোনাদানা খাওয়া-দাওয়া সমেত সর্বমোট ১৩ হাজার কয়েক টাকা খরচ। তখন সোনার দাম ছিল ৪৪০-৪৫০ টাকা। ওসব কথা বললে এখন হয়তো কেউ কেউ হাসবে। কারণ এখন সোনার দাম ৬০ হাজার। একটা সাধারণ মানুষের যেভাবে বিয়ে হয় তার চেয়ে ভালোভাবেই হয়েছিল। কিন্তু একটা ছাপোষা কেরানির বিয়েতেও যে আড়ম্বর থাকে তা আমার ক্ষেত্রে ছিল না। পদে পদে বঞ্চনা, অবহেলা, অভাব লেগেই ছিল। যদিও বৌভাতে ভারতীয় বেশ বড় বড় অনেকেই এসেছিলেন। বিয়ের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি পেয়েছিলাম। প্রণব মুখার্জি, মুচকুন্দ ধ্যুবে, জে.এন. দীক্ষিত, অটল বিহারি বাজপেয়ীসহ আরও অনেকেরই শুভেচ্ছা বাণী পেয়েছিলাম। বৌভাতের প্রায় সব আয়োজন করেছিলেন কংগ্রেস নেতা চুমকির বাবা এমদাদ আলী বাবু মিয়া, কাঠের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, বর্ধমান সরকারি রাজ কলেজের আমার গৃহ শিক্ষক শহিদুল হকসহ আরও কয়েকজন। আসলে জীবনটা কেমন যেন কোনোদিন সোজা পথে চলল না, কোনোকিছু কখনও গতিময় স্বস্তির রূপ নেয়নি। একটি ছন্নছাড়া জীবন বয়ে গেলাম চিরকাল। যখনই অবহেলা পেয়েছি, তখনই কেন জানি আল্লাহর দয়ায় ছোটখাটো আশ্রয় বা ছায়াও পেয়েছি। একেবারে যখন ছোট ছিলাম, পারিবারিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম, তখন মা ওই মা করিমন নেছা বুকে আগলে রাখতেন। একটু বড় হলে রাজনীতিতে অনেক নেতারই চক্ষুশূল ছিলাম। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা কেন যেন চারদিক থেকে ঘিরে থাকত। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ের মুহূর্ত থেকে তার ভীষণ স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছিলাম। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অপরিসীম স্নেহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হয়েছিল নতুন জীবন। একদিকে চরম বিদ্বেষী শত্রুদের ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে হিতৈষীদের অপরিসীম ভালোবাসা। স্বাধীনতার পর কতজন আমার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কান ভারি করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে এক সময় ভারত গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ভীষণ স্নেহ ও সহমর্মিতা পেয়েছিলাম। কংগ্রেস সরিয়ে জনতা দল যখন ক্ষমতায় আসে তারা কংগ্রেসের সবকিছু ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সেই প্রক্রিয়ায় আমিও পড়েছিলাম। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা শ্রী সমর গুহ এমপির সহায়তায় পাটনায় গিয়ে শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণের সমর্থন পেয়েছিলাম। যে কারণে শ্রী মোরারজী দেশাই কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ’৯০-এ দেশে ফিরে অনুকূল স্রোত পাইনি, শুধু শুধু উজানই বয়েছি। উজান বইতে গিয়ে জীবনে কখনও সখনো বাতাসের অনুকূলে হয়তো পাল তুলেছি কিন্তু বেশি সময় নয়। ২৫ জুন আমার বিয়ের দিনে কী করে যে লেখাটি পড়ল ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। এটা হয়তো আল্লাহরই দান। কারণ কিছুদিন আমার লেখা মঙ্গলবার ছাপা হতো। ওই একই দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটা লেখা দেই বলে খুব চাপে পড়তে হতো। তাই কয়েক মাস আগে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সোমবার ঠিক করা হয়। যাক, এটাও একটা আল্লাহর দয়া হিসেবেই ধরে নেব। ২৫ জুন না হলে কথাগুলো বলতাম না। ১৯৭২ সালে কলকাতায় প্রথম সত্যজিত্ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অমন অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ভারত উপমহাদেশে দ্বিতীয় কেউ নেই। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ’৭৭-এর কোনো একদিন দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে তার সঙ্গে দেখা। এখন আর পালাম বিমানবন্দর তেমন নেই। এখন গোরগাও ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সব থেকে বড়। এরপর কতবার যে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কোনো হিসাব নেই। বঙ্গবন্ধুর সমান লম্বা-চওড়া বড় দরদি মানুষ ছিলেন তিনি। সব সময় এটা-ওটা সাহায্য করতেন। নিভৃতে পেলেই বলতেন, ‘টাইগার, যত কিছুই করো, মানুষের একটা জীবনই যথেষ্ট। তুমি যদি একজন মানুষের হাসিকান্না ভালোভাবে তুলে ধরতে পার তাহলে জগত্ জয় করতে পারবে।’ পরে ভেবে দেখেছি সত্যিই তাই। কাহিনীকার একটি মেয়ে বা ছেলেকে নিয়ে তার আনন্দ-বেদনা নিয়ে জাল বুনে। তা ভালোভাবে চিত্রায়িত করতে পারলে শত শত হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর হলে গিয়ে পয়সা দিয়ে দেখে। ও তো শুধু ভালোভাবে উপস্থাপনের কলা-কৌশলের কারণে। অথচ আমাদের কত জনের কত দুঃখ, কত বেদনা, কত হাসি-কান্না, কিন্তু সেগুলো কাউকে স্পর্শ করে না। কারণ স্পর্শ করার মতো করে উত্থাপিত হয় না, বা করার চেষ্টা করা হয় না তাই।
আগেই বলেছি ছেলেবেলায় খুবই দুষ্টু ও চঞ্চল ছিলাম। আমাকে নিয়ে পরিবারের সবাই থাকত বিব্রত। পরিবারের জন্য কত যে মাথা ব্যথার কারণ হয়েছি মস্তবড় হিসাবের খাতা নিয়ে বসলেও হয়তো সব লেখা যাবে না। খাতার পাতা ফুরিয়ে যাবে কিন্তু আমার দুষ্টুমি ফুরাবে না। আমরা ছিলাম দুই মায়ের ১৫ সন্তান। তার পাঁচজন মারা গেছে। আল্লাহর রহমতে ১০ জন এখনও বেঁচে আছি। সঠিক হিসাবে আমি পরিবারের চতুর্থ, আর জীবিতদের মধ্যে দ্বিতীয়, কারণ উপরের দু’জন মরে গেছে। কি কারণে সেই ’৬৬ সাল থেকেই আমার বিয়ের আলোচনা শুরু হয়েছিল। যখন আমি বাড়ি পালিয়ে ’৬৫ সালে সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলাম সেই তখন থেকে। কোথায় ’৬৬ আর কোথায় ’৮৪। চেষ্টা শুরুর ১৮ বছর পর শুভ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির কারণে অনেকের মনে হতে পারে নাসরীন কোরায়শীর সঙ্গে আমার বিয়ে এক প্রেমের সফল পরিণতি। কিন্তু আসল সত্য তা নয়। নাসরীন কোরায়শীর সঙ্গে বিয়ে হতে পারে এটা চিন্তার মধ্যেও ছিল না। ২৮ বছরের বিবাহিত জীবনে তাকে যতটুকু জেনেছি তাতে তারও আমাকে নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ ছিল না। দুই পরিবারে সব সময় ব্যবধান ছিল আকাশছোঁয়া। ছেলেবেলায় লেখাপড়া করতাম না। গরুর রাখাল ছিলাম বলে ওদের কাছে ছিলাম অপছন্দ। আবার স্বাধীনতার পর ওরা সাদাসিধে নিরিবিলি পরিবার হওয়ায় আমাদের কাছে ছিল বেমানান। বিবাহিত জীবনে যেসব কারণে স্বামী-স্ত্রীর খটাখটি হয়, আমার ২৮ বছরের বিবাহিত জীবনে তার কিছুই হলো না। কিন্তু যা নিয়ে কোনোদিন কোনোকিছুই হয় না তার অনেক কিছু নিয়েই স্ত্রীর উপর আমার যেমন মন খারাপ হয়, আমার উপরও হয়তো তার মন খারাপ হয়। জীবনের অনেকদিন এক কথা দু’বার বলার প্রয়োজন হতো না, স্ত্রীর বেলায় বলতে হয়। তাতে আমার মন ভারি হয় কিন্তু ওসবে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিয়ের কয়েক মাস পর একদিন দেখলাম রাজরানীর মুখ ভার। শত চেষ্টা করেও কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। তারও কয়েক মাস পর পত্রিকার এক সাক্ষাত্কারে দেখলাম, পাড়ার বস্তির রিকশাওয়ালাদের ছোট ছোট বাচ্চারা কাদামাটি নিয়ে নাগে পেটাসহ আমার কোলেপিঠে ওঠে, এতে তার ঘেন্না হয়, তাই তার মুখ ভার। আমাকে বলেনি, মাকে বলেনি কিন্তু সাংবাদিকদের ঠিকই বলেছে। আসলে অনেক সময় সাংবাদিকদের সাহায্যে অনেক কিছু জানা যায়। সারা জীবন যে আওয়ামী লীগ করেছি সেই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর হত্যা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করায় ষড়যন্ত্র করে দেশে ফেরার কোনো চেষ্টা করেনি। আমার অতি সাধারণ স্ত্রী বাসে চড়ে দেশের কত জায়গায় যে গেছে, কত কষ্ট যে করেছে তার পরিমাপ করা যাবে না। ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের শত বাধার মুখেও ঢাকা বিমানবন্দর জনগণের পদভারে কেঁপে উঠেছিল। ওর আগে অত মানুষ নাকি ঢাকা বিমানবন্দরে আর দেখেনি। আমার রাজকন্যার মতো কুড়িমণি, রাজপুত্রের মতো দীপ। ওরা যখন জন্মে ওদের ভালোভাবে লালন-পালন করেনি। সন্তান পেশাব-পায়খানা করায় কোনো মা অসন্তুষ্ট হয়, আমার স্ত্রীকেই প্রথম দেখেছি। তাতে বিরক্ত হতাম, মন খারাপ লাগত। কিন্তু কুশিমণি যখন এলো সব দুর্বলতা কেটে গেল। আমার স্ত্রী পরিপূর্ণ মা হলেন। ওর পেশাব-পায়খানা, কাপড় ছেঁড়া, নষ্ট করার জন্য কোনো অনুযোগ রইল না। কুশিকে ছাড়া এখন আর তার মা’র ঘুম হয় না, মুখে খাওয়া রোচে না। কুশিমণি দীপ-কুড়ির প্রাণ, মায়ের কলিজা। আমার তো কথাই নেই। ওকে ছাড়া আমি শ্বাস নিতে পারি না, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বাসায় থাকলে কারণে-অকারণে ঘুরঘুর করে। অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারী সে। সাহেবী রং-ঢংয়ের মানুষের মতো শহরের ভাবধারা এখনও রপ্ত করতে পারিনি। ক্লাবে যাওয়া, হোটেলে খাওয়া, এখানে-ওখানে আড্ডা দেয়া ওসব আজও হলো না। আমার স্ত্রী নিশাচর পরিবারের সন্তান। ওরা রাতে জাগে, দিনে ঘুমায়। আমি দিনে জাগি রাতে ঘুমাই। এসব কম-বেশি ব্যতিক্রম নিয়েই মানিয়ে চলছি। কারণ এটাই জীবন। এখনও সব থেকে বড় সমস্যা আমার মা যা রাঁধতেন সবই হতো অমৃত। আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও খুব ভালো রাঁধতে পারেন। তার মায়ের রান্নাও ছিল অসাধারণ। মায়ের অসাধারণ রান্নার কাছে স্ত্রীর হেলাফেলা কিছুটা অতৃপ্তির তো অবশ্যই সৃষ্টি করে। কিন্তু তবু স্ত্রী-পুত্র, পরিবার নিয়ে ৬৭ বছরের ২৮ বছর বিবাহিত জীবন মোটামুটি ভালোই কাটছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেদিন মানুষের কোনো কাজে লাগব না সেদিন যেন তিনি সুস্থ শরীরেই উঠিয়ে নেন। আর যতক্ষণ তার দয়ায় জীবন আছে ততক্ষণ যেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, সন্তান-সন্তুতি নিয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেকে উত্সর্গ করার তওফিক দেন। দেশবাসীর কাছে এই শুভদিনে মিনতি করি তারা যেন স্রষ্টার কাছে আমাদের জন্য একটু দয়ায় দোয়া করেন। আমীন।

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

পিতাকে পুত্র

পিতাকে পুত্র


॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ॥

১১
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
দুইশত পঞ্চান্ন বছর আগে ভাগীরথীর তীরে পলাশীতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়েছিল। বহু রক্ত, ত্যাগ-তিতিা ও সংগ্রামের বিনিময়ে ভারতবর্ষ থেকে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিতাড়িত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে হয়তো এখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আমাদের কব্জা করেই থাকত। জার্মানির বলদর্পী এডলফ হিটলার ফুরার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মাজা ভেঙে দেয়ায় তারা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মান জাতির ওপর অতি মাত্রায় শর্ত চাপানোর মাধ্যমে ভার্সাই চুক্তির মধ্যে। কোনো দেশ কোনো জাতির ওপর অমন নিষ্ঠুর নিদারুণ অসম্মানজনক শর্ত চাপালে পরিণতি যা হয় তাই হয়েছিল। এখনো অমন করলে যা হওয়ার তাই হবে। ভবিষ্যতেও এর কোনো হেরফের হবে না। তাই যখন যে মতায় বা শক্তিতে থাকুক তাকে মনে রাখতে হবে চিরকাল কেউ সবল থাকে না। 
আজ রাুসী পলাশী দিবস। তাই মুর্শিদাবাদ ও পলাশীকে ঘিরেই দু-এক কথা আলোচনা করি। তুমি কখনো পলাশীতে যাওনি। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় কখনো মুর্শিদাবাদ ও বহরমপুর গেছ কি না জানি না। কিন্তু জাতির পিতা হয়ে কখনো সেখানে যাওনি। আমি মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, মালদা বেশ কয়েকবার গেছি। কিন্তু একেবারে প্রথম গিয়েছিলাম ’৭২ সালের এপ্রিলে। তখনো দু’দেশের মধ্যে পাসপোর্ট চালু হয়নি। নিজেদের পারাপারের কাগজপত্র নিজেরাই লিখে দিয়েছিলাম। সংখ্যাটা ঠিক মনে নেই তবে এক শ’ জনের বেশি হবে। ৯ এপ্রিল টাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়েছিলাম। ছোট-বড় ৯-১০টি গাড়ি ছিল সাথে। যাত্রীদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা হলেন প্রখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদ, কবি রফিক আজাদ, মরহুম লোকমান হোসেন ফকীর, গায়ক ফারুক, ওস্তাদ ফারুক, মরমি পল্লীগীতি শিল্পী আবদুল আলিম, টাঙ্গাইলের ফারুক কোরায়েশী, রতন ঠাকুর, আতোয়ার রহমান খান, রঞ্জিত কান্ত সরকার, আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, আফতাবুজ্জামান খান ফিরোজ, ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, মেজর হাবিব বীরবিক্রম, আমার ছোটবোন রহিমা, শুশুমা, শেলী, নাজনীন আরো কয়েকটি মেয়ে ও অন্যরা। জামালপুর, শেরপুর, ঝিনাইগাতী সীমান্ত দিয়ে বারেঙ্গাপাড়া-তুরা হয়ে মানকারচর, ধুবড়ী, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, মালদা হয়ে মুর্শিদাবাদ পৌঁছেছিলাম। সে এক লম্বা পথ। আমরা দুই রাত্রী ছিলাম বহরমপুর সার্কিট হাউজ, ট্যুরিস্ট লজ ও অন্যান্য ঘর-দুয়ারে। 
বহরমপুর জেলা শহর থেকে মুর্শিদাবাদ হাজারদুয়ারী চার-পাঁচ কিলোমিটার হবে। তখন ভাগীরথী নদীতে কোনো পানি ছিল না। পশ্চিম পারে সিরাজের সমাধিতে অনায়াসেই যাওয়া যেত। হাজারদুয়ারী জাদুঘর একটি সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। মোটামুটি সবই আছে। আলীবর্দী খাঁর কবর, সিরাজউদ্দৌলার, লুৎফার। তবে বিস্মিত হয়েছিলাম এক বিশাল ভবনের সিঁড়ির কাছে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর আলী খাঁর কবর। দুর্গন্ধে সেখানে টেকা যায় না। গাইডকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘ওখানে মীরজাফরের কবর। লোকজন এখনো পেশাব করে।’ ভারতে ১৬ বছর নির্বাসিত ছিলাম। পরে অনেক খোঁজ নিয়ে দেখেছি ঘটনাটি সত্য। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার পতনের ইতিহাস বা নবাবের পতনের ইতিহাস বড় মর্মান্তিক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফেরার পর নবাব দু-তিন দিন প্রাসাদেই ছিলেন। তারপর পুর্নিয়ার নবাবের সহায়তার আশায় নদীপথে পাটনার উদ্দেশে রওনা হলে ভাগীরথীর তীরে ভগবানগোলা থেকে মীরজাফরের জামাতা মীর কাসিম তাকে গ্রেফতার করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসে। মীরজাফরের ছেলে মিরনের ষড়যন্ত্রে মোহাম্মদী বেগ তাকে কারাগারে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। অথচ সিরাজউদ্দৌলার মা এতিম মোহাম্মদী বেগকে পুত্রের মতো লালন-পালন করেছিলেন। আল্লাহর কী বিচার! মীরজাফরের পুত্র মিরন সিরাজের স্ত্রী লুৎফা ও কন্যাকে ভাগীরথীতে নৌকাডুবিয়ে মেরেছিল, সেও পানিতে ডুবে মরেছে। মোহাম্মদী বেগ ঠাটা পড়ে মরেছে। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর কুষ্ঠরোগে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। আর মীরজাফরের জামাতা স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক মীর কাসিমকে ইংরেজরা মীরজাফরের পরিবর্তে এক গাদা টাকা নিয়ে নবাব বানালে ইংরেজের সাথে তার বিরোধ শুরু হয়। তখন মীর কাসিম রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে সরিয়ে নেন। সেখানে উজয়নালার বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের সাথে পরাজিত হয়ে সর্বস্বান্ত মীর কাসিম অযোধ্যার রোহিলাখণ্ডের দিকে চলে যান। সেখানে কিছুকাল আত্মগোপন করে হতদরিদ্র অবস্থায় মারা যান। রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ, ইয়ার লতিফ যারাই ষড়যন্ত্র করেছিল কারোরই পরবর্তী জীবন ভালো হয়নি। ঠিক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তোমাকে যারা হত্যা করেছিল, যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের একজনের জীবনও ভালো ও সুস্থ হয়নি। সে মোশতাকই বলো আর ফারুক-রশীদ-ডালিমই বলো কেউ শান্তি পায়নি, স্বস্তি পায়নি। 
ইতিহাসে সব সময় এমনই হয়। ফোরাতের তীরে কারবালায় যারা মহানবী সা:-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবার-পরিজনের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল তারাও ধ্বংস হয়েছে নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়েই। কিন্তু তার পরও কেন যেন মানুষ ইতিহাস থেকে শিা নিতে চায় না। ’৭২-এ যখন মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোডের পাশে একের পর এক বাবলাগাছ দেখছি। তাতে কত শত হাজার হাজার বীর সিপাহিদের ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল কত বা সময়Ñ এক শ’ বছর। বিদ্রোহ করায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল। ঢাকাতেও বাহাদুর শাহ পার্কে অমন করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা তা যতœ করে রা করি না। কারণ এখন জাতি হিসেবে আমরা বড় হালকা হয়ে গেছি। বর্তমান নিয়ে সবাই বড় বেশি ব্যস্ত। অতীতের প্রতি কারো কোনো খেয়াল নেই। কেউ সেখান থেকে শিাও নেয় না। ১৮৫৭ সালে বারাসাতের ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডে প্রথম বিদ্রোহ করেছিল। সেই বিদ্রোহ দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। বাহাদুর শাহ জাফরকে স্বাধীন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ইংরেজের শক্তির কাছে ভারতবাসী হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত শক্তি এঁটে ওঠেনি। তাই নির্বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ভারতকে পদানত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার মাত্র ৯০ বছর পরই সেই বলদর্পী ব্রিটিশকে লেজ গুটিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের জন্য আমাদের নিন্দা করত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। কিন্তু আজ ব্রিটিশের ফাঁসিতে ঝুলানো সেই বীর সিপাহিদেরই সারা পৃথিবী সালাম করে, শ্রদ্ধা জানায়, সম্মান দেখায়। যারা ঝুলিয়েছিল সেই ব্রিটিশকে এ কাজের জন্য কেউ সম্মান করে না বরং নিন্দা করে। তাই কোনো কিছুই সব সময় এক থাকে না। 
এত দিন বলিনি কিন্তু সময় বহিয়া যায়। দু’বছর আগে আমাদের বিডিআরের ঘটনা যেভাবে মোকাবেলা করা হলো এখন বিচার-আচার হচ্ছে। ভবিষ্যতের কাছে এগুলো কতটা যথার্থতা পাবে নিখুঁতভাবে ভেবে দেখা দরকার। পিতা, তোমাকে কিছু বলতে গেলেই একসাথে সব কথা হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে চায়। কত বছরের কত কথা সবাই এক প্রতিযোগিতায় নেমে যায়, কে তোমার কাছে আগে যাবে। আমরা যেমন তোমার পাগল, মনে হয় আমাদের কথাগুলো, অনুভূতিগুলো তোমার সামনে হাজির হতে আরো বেশি মহাপাগল। আমরা ছিলাম কলকাতার পথের যাত্রী। জগদ্বিখ্যাত পল্লীগীতি গায়ক আবদুল আলিমের বাড়ি মুর্শিদাবাদ। বড় সাদাসিধা মানুষ ছিলেন। ভারত থেকে পাকিস্তানে আসার পর একবারো আর তার বাপ-দাদার ভিটায় যাননি। খুব সাহস করে যেন কাকে বলেছিলেন, আমারও তার বাড়ি দেখার খুব শখ হয়েছিল। কলকাতা মহাসড়ক থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে তার বাড়ি। অন্য সবাইকে রেখে আমরা ২০-২৫ জন মরমি শিল্পী আবদুল আলিমের বাড়ি গিয়েছিলাম। ছন ও টিনের ঘরের অতি সাধারণ বাড়ি। আশপাশে বাঁশঝাড়, আম, জাম নানা গাছপালা। আমাদের দেশের একেবারে সাধারণ কৃষকের যেমন হয় ঠিক তেমনই। এরপর গিয়েছিলাম পলাশীর প্রান্তরে। 
পলাশীর কত বর্ণনা পড়েছি, ব্যাখ্যা শুনেছি। গিয়ে দেখলাম রাস্তা শেষে যেখানে ধানতে শুরু সেখানে একটা ছোট্ট মনুমেন্ট ১৫-২০ ফুট উঁচু একটা পিলারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেই আমবাগান, কলাবাগান কোথাও কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। প্রথম প্রথম বেশ হতাশই লাগল। পরে ধীরে ধীরে ভাবলাম ২০০ বছর আগের ঘটনা কেমন করে তেমন থাকবে? ইচ্ছেমতো মনের আনন্দে এদিক-সেদিক ঘুরে দেখলাম। ভাবলাম সে দিনের সেই যুদ্ধের কথা। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজের সৈন্য ছিল মোটামুটি তিন হাজার। তার মধ্যে মাত্র তিন শ’ ইংরেজ। আর বাকি সবই ভাড়াটিয়া ভারতীয়। অস্ত্রও তেমন বেশি ছিল না। ৭০-৭২টি রাইফেল, বন্দুক, কয়েকটা গাদাবন্দুক, ছোটখাটো কয়েকটা কামান। অন্য দিকে মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ এদের সেনাবাহিনীর অধীনে প্রায় ৭০ হাজারের ওপর নবাবের সৈন্য ছিল। সেখানে তীরন্দাজ, গোলন্দাজ, ঘোড়সওয়ার, পদাতিক কোনো অভাব ছিল না। নবাবের হাতেও বন্দুক ছিল, ছিল কামান। কিন্তু যুদ্ধের সময় দেখা গেল ইংরেজের আক্রমণের বিরুদ্ধে শুধু মীরমদন, মোহনলাল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মোহনলালের গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলায় ইংরেজরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল। ফরাসি বীর চিনফ্রে প্রাণপণ লড়াই করছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে। জান বাঁচাতে ইংরেজরা যখন নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাচ্ছিল তখন ষড়যন্ত্রের শর্ত অনুসারে মীরজাফর নবাবের কাছে গিয়ে যুদ্ধবিরতির প্রার্থনা করেন। নবাব জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন? আপনারা যুদ্ধে অংশ না নেয়ার পরও মীরমদন, মোহনলাল ইংরেজদের পিছু হটিয়ে দিয়েছে। এ সময় যুদ্ধবিরতি কেন?’ মীরজাফর নবাবকে বলেন, ‘সৈন্যরা অনেকেই কান্ত হয়ে লড়েছে তাই আজ যুদ্ধবিরতি করে কাল আমরা নবোদ্যমে যুদ্ধ শুরু করলে ইংরেজরা অল্প সময়ের মধ্যেই পরাজিত হবে।’ নবাব প্রধান সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর ইংরেজ যদি রাতের আঁধারে আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে?’ এক সময় মোহনলাল আহত হওয়ায় নবাব যুদ্ধবিরতির আদেশ দেন। যুদ্ধবিরতির খবর শুনে ফরাসি বীর চিনফ্রে নবাবের শিবিরে ছুটে আসেন। নবাবকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পরিকল্পনা হইল এক রকম, যুদ্ধ হইতেছে আরেক রকম। ব্যাপারটা কী?’ নবাব তাকে ধমক দিয়ে বের করে দেন। পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।
মজার ব্যাপার ভাগীরথীর তীরে পলাশীতে যে সময় ইংরেজ আর নবাবের যুদ্ধ হচ্ছিল, তখনো জেলে নদীতে মাছ ধরছিল, কৃষক হাল চালাচ্ছিল, অন্যান্য মানুষ যে যার নিত্যকাজে ব্যস্ত ছিল। তারা বুঝতেও পারেনি তাদের অজান্তে কত বড় তি হয়ে গেল। আজো যেমন দেশে কত কিছু হচ্ছে সাধারণ মানুষ মনে করছে তাদের কিছুই করার নেই। এটা সরকার ও বিরোধী দলের ব্যাপার, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ব্যাপার। কিন্তু যখন সব হারিয়ে যাবে তখন হয়তো তারা বুঝতে পারবে। এই আধুনিক জমানায় হারানোর আগে বুঝলেই ভালো। পলাশীর প্রান্তর ঘুরেফিরে যখন গাড়িতে উঠতে যাবো তখন দেখি আমাদের এক গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে কবি রফিক আজাদ ও আরো কে যেন মারাত্মক আহত হয়েছেন। কোনো জায়গা পরিদর্শনে গেলে রাস্তাঘাটে সহযাত্রী আহত হলে সে ভ্রমণের আর কোনো মজা থাকে না। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে দুর্ঘটনাকবলিতদের মারাত্মক তি হয়নি। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের সাথে নিয়ে আমরা আবার রওনা হলাম। এ পর্যায়ে কলকাতায় পৌঁছলে আমাদের স্বাগত জানালেন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শঙ্কর প্রসাদ মিত্র ও আরো কে কে। ছোট মানুষ অত বড় বড় মানুষকে দেখে অভিভূত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম। বিশেষ করে আকাশবাণীতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কথিকা শুনেছি, আলোড়িত হয়েছি। সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের স্বাগত জানাতে দেখে আরো বেশি অভিভূত হয়েছিলাম। 
(চলবে)

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

আমার প্রতি এত আক্রোশ কেন? -২

জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় আজ চার-পাঁচ দিন তেমন স্বস্তি পাচ্ছি না। ভালোভাবে কোনো কাজ করতে পারছি না। তার ওপর শুভ-অশুভ নানা খবরে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আনন্দময় শুভ খবর দিয়েই শুরু করি। বহু বছরের তপস্যার ফল হিসেবে বোধহয় একজন নিখাদ বাঙালি আগামী মাসে মহান ভারতের মহামহিম রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। তিনি আর কেউ নন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কির্নাহারের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ইন্দিরাজীর ভাষায় ভারতের হিউম্যান কম্পিউটার শ্রী প্রণব মুখার্জি। তার সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমার দেশ-এ দু-কলাম লিখেছি। আশা করি আগামী মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভালোয় ভালোয় তার শপথ হয়ে গেলে তাকে নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনেও অবশ্য অবশ্যই কিছু লিখব। আজ শুধু ১৬ কোটি সংগ্রামী বাঙালি এবং আমার পরিবার-পরিজন ও আমার পক্ষ থেকে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হওয়ায় তাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাচ্ছি।

কিছুদিন ধরে মানবতার কান্না শুনে স্থির থাকতে পারছি না। কেন যেন বার বার '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। হাজার হাজার লাখ লাখ উদ্বাস্তুর স্রোত যখন প্রতিবেশী ভারতের দিকে ছুটে চলছিল, তখন কেমন যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল সন্তানসম্ভবা মায়েদের সেদিনের বোবা কান্না, হৃদয়ের তন্ত্রীতে বীণার ঝঙ্কারের মতো এক বেদনার অসহনীয় জ্বালা। সেই দুঃসময়ে কত ক্ষত-বিক্ষত আহত দেখেছি, নিহত দেখেছি। দেখেছি সন্তানসম্ভবা মায়ের যন্ত্রণা। সদ্য সন্তান প্রসবা মায়ের পবিত্র রক্তে মাটি লালে লাল হতে দেখেছি। তাই সেরকম মানবতার দুঃসময়ে রক্তের দামে কেনা আমার দেশ যখন মানবতার বিরুদ্ধে কাজ করে তখন বিচলিত না হয়ে পারি না। ১৪ জুন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির নির্দয় কণ্ঠের ৩০০ বিধির বিবৃতি দেশবাসীকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। জীবন বাঁচাতে আশ্রয়ের আশায় ছুটে আসা মুসলিম রোহিঙ্গারা এভাবে একটি মানবতাবাদী দেশের কাছ থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে যাবে, এটা হয়তো তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। দীপু মনির বিবৃতি অনুসারে শরণার্থীদের ফেলে যাওয়া নৌকার খোলে পড়ে থাকা তিন মাসের শিশুকে কোনো শরণার্থী শিবিরে দিয়েছেন। তিন মাসের শিশু কোনো দীপু মনি, আপুমণি চায় না_ তার মামণির দরকার। আমার ছোট শিশু কুশিমণি যখন তার মায়ের বুকে মুখ লাগিয়ে আকুলি-বিকুলি করে তখন বুঝি শিশুর কাছে মায়ের কোনো বিকল্প নেই। তার মা চাই, মায়ের বুকের দুধ চাই। এ থেকে যারাই কাউকে বঞ্চিত করবে তারা বা তাদের এপারে না হোক ওপারে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

তাই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, মিয়ানমার শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশ যেন কোনো মানবতাবিরোধী আচরণ না করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আমাদের ওপর যথার্থই খুব একটা চাপ দিতে পারে না, এটা স্বীকার করেও বলব, বাংলাদেশের চোখের সামনে কখনো কোনো মানবতা ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না। আমার দেশের সীমানা পর্যন্ত এসে কোনো মানুষ যদি প্রাণ হারায়, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের মৃত্যু। স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ শহীদের রক্তদানের অপমৃত্যু। শরণার্থীদের আসতে উৎসাহিত করা নয়, যারা জীবন বাঁচাতে দ্বারে এসে পা দিয়েছে, তাদের পায়ের নিচে যেন বাংলাদেশের মাটি কেয়ামত পর্যন্ত নিশ্চিত থাকে। মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গা সমাধানে সরকার যদি অপারগ হয়, নিঃসন্দেহে আমাদের মতো কিছু বেকারকে অবশ্যই কাজে লাগাতে পারেন।

লেখাটি শুরু করতে চেয়েছিলাম সর্বক্ষেত্রে জাতীয় আক্রোশের কারণে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে। গত পর্বে আমাকে নিয়ে, আমার বাবর রোডের বাড়ি নিয়ে ছোটখাটো বেশ কয়েকটি কথা বলেছিলাম। তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে ব্যাপক। প্রায় দুই বছর ধরে নিয়মিত লিখি। অনেক পাঠক চিঠিপত্র লেখেন, ফোন করেন। তাছাড়া নানাভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়া কখনো পাইনি। নানা কারণে দেশের মানুষ বেশ উদাসীন ও হতাশ। অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে ফায়দা লুটার প্রবণতা সর্বত্র। এই প্রথম অনেককে বলতে শুনলাম প্রয়োজন হলে চাকরি-বাকরি, কাজ-কর্ম ছেড়ে আপনার সঙ্গে শরিক হব। আলহামদুলিল্লাহ। তাদের এই ইচ্ছা যেন আল্লাহ কবুল করেন। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে লেখাটি বেরুবার সময় আমি ছিলাম টাঙ্গাইলে। রাস্তায় যানজট থাকায় সংবাদপত্র দুপুর ১২টায় পেঁৗছেছে। কিন্তু সাড়ে ৭টায়ই দিনাজপুর থেকে মকসুদের ফোন এলো_ 'লিডার, এসব কি? আমরা তো জানি স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আপনাকে বাড়ি দিয়েছেন। সবাই সারা দেশ দখল করে নিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাড়ি নিয়ে এত কথা! এর একটা বিহিত করতেই হবে।' একটু পরেই ফোন পেলাম আকতারুজ্জামান নামে এক ভদ্রলোকের। আমি তাকে জানি না, চিনি না, কখনো কোনোদিন দেখা হয়নি। ভদ্রলোক আমার একজন পাঠক। তিনি বললেন, 'সিদ্দিকী সাহেব, কোনো চিন্তা করবেন না। আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবে।' আরও বললেন, 'তার অনেক লোক আছে। বাড়ির কাগজপত্র ঠিক করে দেবেন।' একজন অপরিচিত মানুষের এতবড় কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা বেঁচে থাকতে যখনই কোনো ঝড়-তুফান এসেছে, পাশে গেলেই মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, 'কোনো চিন্তা করিস না, এ দুনিয়ার যত অলি, আবদেল, গাউস, কুতুব আছেন, তারা কারও জন্য দোয়া করলে সে দোয়া প্রথম যাবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে। তিনি রাজি-খুশি হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তবেই সে দোয়া বা প্রার্থনা আল্লাহর আরশে পেঁৗছবে। আর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাবা-মা'কে এত ক্ষমতা দিয়েছেন যে, তারা যদি সন্তানের জন্য দোয়া করেন, তাহলে সে দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে পেঁৗছে। আর আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন, সন্তানের জন্য পিতা-মাতার নেক দোয়া তিনি কখনো অপূর্ণ রাখবেন না।' ডেমরার দিকে আমার এক পাঠক আছেন। মাঝে মধ্যেই ফোন করেন। তার ফোন পেয়ে আমারও বেশ ভালো লাগে। লেখাটি পড়ে রেগে অস্থির। তিনি বললেন, 'আমি যদি কোনোদিন প্রধানমন্ত্রী হতাম তাহলে বাংলাদেশের অর্ধেক আপনাকে লিখে দিতাম।' হঠাৎ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এক ফোন এলো, 'আপনার লেখা পড়ে কেঁদেছি। শতকরা ৯০ জন পুলিশ আপনার লেখা পড়ে কেঁদেছে। কি সব অসভ্য লোকজন আপনাকে নিয়ে কথা বলে। তাদের আপনাকে নিয়ে কোনো কথা বলার ক্ষমতা নাই। তারা সবাই দুর্নীতিবাজ। সরকারের ৬০ ভাগ এখন রাজাকার আর দালাল। প্রায় সবার আত্দীয়স্বজন রাজাকারে ভরা। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। দরকার হলে চাকরি ছেড়ে আমরা আপনার সঙ্গে দাঁড়াব।' সিরাজগঞ্জের এক ভদ্রলোক ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, 'আপনি এখনই সরকারকে চিঠি দেবেন। কাদেরিয়া বাহিনীর জাদুঘরের জন্য সরকার ঢাকা শহরে দরকার পড়লে ১০ একর জায়গা দেবে। যদি কোনোখানে জায়গা না পায়, যেখানে নিয়াজি আপনাদের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে প্রাণভিক্ষা নিয়েছে, সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে দেবে। দরকার পড়লে শাহবাগ থানা সরিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাদেরিয়া বাহিনীর জাদুঘরের জন্য দেবে। আপনি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিন। বাবর রোডের বাড়ি কেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাড়ি আপনাকে দিতে হবে। কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। আপনি কিছুতেই কাউকে ছাড় দিতে পারবেন না।' কবি আল মুজাহিদীর কন্যা ফোন করেছিল। ওর ফোন আগে কোনোদিন ধরিনি বা পাইনি। বলল, আব্বা কথা বলবেন। অন্যদিনের মতো স্বাভাবিকভাবে বললেন, 'কাদের ধৈর্য ধরো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। জাতির জন্যই তোমাকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন।' ফোন পেলাম ব্যাংকের এক এমডির, 'স্যার, আপনি উচিত কথা লিখেছেন। আপনার বিরুদ্ধে যথেষ্ট বদনাম করা হয়েছে। আর সহ্য করা চলে না। আপনি আরও লিখবেন।' আমার স্ত্রীর এক পাগল বান্ধবী রিতা এক ঘণ্টা গালাগালি করে গেল। তাকে কিছুতেই ঠাণ্ডা করতে পারলাম না। তার কথা, 'বঙ্গবন্ধুর বরাদ্দই যদি না থাকে তাহলে আর কারও কোনো বরাদ্দ থাকবে না। কাদের সিদ্দিকী যদি অবৈধ হয়, তাহলে মন্ত্রী-মিনিস্টার সব অবৈধ, সারা দেশ অবৈধ।' শত চেষ্টা করেও তাকে বুঝাতে পারলাম না, শান্ত করতেও পারলাম না। পরদিন ফোন পেয়েছিলাম পীর হাবিবের। বহুল প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক। খুবই ভালো লেখেন। যেমন কলমের জোর তেমনি আত্দার।

অফুরন্ত ভালোবাসা ফুটে ওঠে তার কথাবার্তায়, চাল-চলনে। বললেন, 'দাদা, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুকে মাফ করে দেন। এখন তো সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা এক সময় এক সঙ্গে থেকেছি। তাই ওর জন্য বড়বেশি বুকে বাজে।' পীর হাবিবের একজন মৃত সহকর্মীর জন্য দরদ দেখে বড়বেশি মুগ্ধ হয়েছি। আমি লিখেছিলাম '৯৯-এর সখিপুর-বাসাইলের উপনির্বাচনে ভোট ডাকাতের দলে টিংকুও শামিল হয়েছিল। কথাটা ধ্রুবতারা-চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্য। হাইকমান্ডের কমান্ড মেনে একজন মেধাবী ছাত্র যে কোনোদিন লেখাপড়ায় দ্বিতীয় হয়নি তাকে যেতে হয়েছিল ডাকাতি করতে। আমি ওকে আগাগোড়াই পছন্দ করতাম, ভালোবাসতাম। আর মাফ করে দেওয়ার কথা? সে বহু আগেই আমার বাড়ি এসে মাফ চেয়ে নিয়েছিল। আমিও অন্তর থেকে ওকে মাফ করেছিলাম। কিন্তু জানতাম না আল্লাহ ওকে এত তাড়াতাড়ি এপার থেকে ওপারে নিয়ে যাবেন। টিংকুর গুরুতর অসুস্থতার সময় আমি ওকে ওর বাড়ি গিয়ে দেখে এসেছি।

টিংকু কত ভাগ্যবান, শুধু বন্ধুত্বের কারণে পীর হাবিবের মতো একজন মানুষ আমাকে অনুরোধ করেছে। তার অনুরোধ শুনে হৃদয় জুড়িয়ে গেছে। আর নিজেকে বড়বেশি হতভাগ্য মনে হয়েছে। কত রাজনৈতিক সাথী-কর্মীকে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছি, বিয়ে দিয়ে সংসারী করিয়েছি, তাদের ছেলেমেয়ে হলে অনেক ছেলেমেয়েকেও বিয়ে দেওয়ায় ভূমিকা রেখেছি। কর্মীদের জন্য করতে করতে দেউলিয়া হয়ে গেছি। ব্যাংকে বিপুল ঋণের শিকার হয়েছি। তারপরও সে সব রাজনৈতিক কর্মী কেউ কেউ স্বার্থসিদ্ধির জন্য কখনো কখনো আমার নামে বিষ পান করে। কি আমাদের কপাল! আর কি কপাল অন্যদের! জাতীয় এই অবক্ষয়ে আজ আর ঘরে থাকার সময় নেই। দেশকে বাঁচাতে হলে, আগামী প্রজন্মকে একটি শান্তিময় বাসযোগ্য আবাসভূমি দিয়ে যেতে চাইলে ছোটখাটো ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আসুন আমরা আজ থেকেই সে কাজ শুরু করি।

লেখক : রাজনীতিক

সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

মহামহিম বাঙালি প্রণব মুখার্জি



ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম
বেশ কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল এবার ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদ একজন বাঙালি অলঙ্কৃত করবেন। ধীরে ধীরে সেই সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, যার পরিসমাপ্তি ঘটেছে ১৫ জুলাই বিকালের দিকে। বর্তমানে ভারতের শাসক জোট ইউপিএ, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অতি সামান্য। ইউপিএ’র শক্তিশালী এক শরিক মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস। শ্রী মুখার্জিকে সবাই সমর্থন করলেও মমতা ব্যানার্জি একজন বাঙালি হয়েও আরেকজন খ্যাতিমান বাঙালিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সঙ্গে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন সমাজবাদী দলের কর্ণধার পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ মুলায়ম সিং যাদবকে। তার সঙ্গে কী কথা হয়েছে না হয়েছে তা তিনিই জানেন। তবে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে তিনি এপিজে আব্দুল কালাম, ড. মনমোহন সিং, সাবেক স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জির মধ্য থেকে কাউকে সমর্থন করেন। এ যেন মামার বাড়ির আবদার। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন হাস্যকর অবাস্তব প্রস্তাব আর কখনও কোথাও হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। কোনো দেশের নির্বাচিত দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপতি পদে কেউ কোনোদিন প্রস্তাব করেছেন কিনা তাও বলতে পারব না। মনে হয় প্রস্তাব দেয়ার আগে এপিজে আব্দুল কালামের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জি কোনো কথা বলারও প্রয়োজনবোধ করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে কথা বলার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর সোমনাথ চ্যাটার্জি সিপিএম-এর মানুষ। মমতা ব্যানার্জি চিরকাল সিপিএম-এর দুশমন, চরম বিরোধী। এর পুরস্কার হিসেবেই কত প্রবীণ নেতা থাকতেও তিনি পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম-বিরোধী নেতা হয়েছেন। তিস্তার পানি বণ্টনে বাগড়া দিয়েছেন। তার অন্তরাত্মা, বিবেক যা বলেছে করেছেন। তিনি যখন ছোট ছিলেন, তার যখন কোনো নামধাম ছিল না, ভারতবাসী বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে তখন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছে। এখন তিনি বড় হয়েছেন, নেতৃত্ব পেয়েছেন। কারবালার তীরে যেমন মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেন এবং তাঁর পরিবারকে ফোরাতের পানি বন্ধ করে সীমার এজিদরা জানে মেরেছিল, নয়া জমানার এজিদরা না হয় তিস্তার পানি বন্ধ করে আমাদের মারার চেষ্টা করবেন এতে আর বিচিত্র কী! তবে দেড় হাজার বছর আগে যেমন এজিদ সীমাররা জয়ী হয়নি, এখনও হবে না এটা সবার জানা থাকা দরকার। প্রায় সব দল প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন দিলেও মমতা ব্যানার্জি বলেছেন তার খেল শেষ হয়নি। আগামী মাসে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে হয়তো শেষ হবেও না। তবে বল তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। মুলায়ম সিং যাদব একজন তীক্ষষ্ট, ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা। তাঁকে সেই ’৮০-এর আগে থেকে দেখছি মমতা ব্যানার্জি যখন সাধারণ এবং খুবই ছোট ছিলেন সেই তখন থেকে। ইউপিএ প্রথম সরকারের সময় প্রণব মুখার্জির পালক পুত্র পিন্টুর বিয়েতে গিয়েছিলাম। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের সুবার্তু পার্কে পিন্টুর বৌ-ভাতের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে দেখা হতেই বলে উঠেছিলেন, ‘টাইগার দাদা আপকো ভি লে আয়া?’ বিহারের আলোচিত নেতা লাল্লু প্রসাদ যাদব, তিনি তার দল নিয়ে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন দিয়েছেন। লাল্লু প্রসাদ যাদবের স্ত্রী শ্রীমতী রাবড়ী দেবী ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত পড়া একজন গৃহিণী, বাড়িতে গরুর দুধের খামার করতেন। তিনি খুবই যোগ্যতার সঙ্গে দুই-দুইবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর পদ সামলেছেন। উত্তর প্রদেশের নামকরা নেত্রী মায়াবতী সমর্থন দিয়েছেন প্রণব মুখার্জিকে একজন যোগ্য, দক্ষ, উপযুক্ত মানুষ হিসেবে। বিরোধী জোটের মূল দল বিজেপির নেতারাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রণব মুখার্জির প্রশংসা করেছেন। এমনকি এনডিএ’র প্রধান শ্রীমতী সুষমা স্বরাজ প্রণব মুখার্জির প্রতি ব্যক্তিগত সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। লালকৃষ্ণ আদভানি করেছেন, দক্ষিণের করুণানিধি করেছেন, মহারাষ্ট্রের শারদ পাওয়ার করেছেন, কাশ্মীরের ওমর আবদুল্লাহ করেছেন। কিন্তু একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দিল্লির সর্বোচ্চ আসনে বসার সুযোগ বা সম্মান থেকে বাঙালিকে বঞ্চিত করতে চান। ভারতবর্ষ বা ভারত উপমহাদেশে হাজার বছরের শাসনে দিল্লির শীর্ষ আসনে কোনো বাঙালি বসেনি। সেটা স্বৈরতন্ত্র হোক, গণতন্ত্র হোক, রাজতন্ত্র অথবা পাঠান, মোগল, সুলতানী আমল যখনই হোক, এই প্রথম একজন বাঙালি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দিল্লির সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে চলেছেন। যেখানে বাঙালি হিসেবে সবার উদ্বেলিত বা খুশি হওয়ার কথা, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র বাঙালি মুখ্যমন্ত্রী সবচাইতে বেশি অখুশি বা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। স্রষ্টা না করুন ভারতে আর পাঁচটা রাজ্যে পাঁচজন মমতা ব্যানার্জি যদি হন তাহলে আমাদের চাইতে করুণ দশা হবে তাদের। আমাদের এক মরহুম মহান রাজনীতিবিদ বাংলার গর্ব ময়মনসিংহ ত্রিশালের সন্তান আবুল মনসুর আহমেদের একটা গল্পের সামান্য তুলে ধরি। কবে একদিন মর্ত্যের কিছু নেতানেত্রীকে স্রষ্টা বেহেশত-দোজখ পরিদর্শনের সুযোগ দিয়েছিলেন। সেখানে নাকি আবুল মনসুর আহমেদও ছিলেন। বেহেশত দেখা শেষে দোজখে এলে নানা জায়গায় নানা শাস্তি দেখতে পান। কারও মাথা ফাটছে, আবার মাথা জোড়া লাগছে। কাউকে টুকরা টুকরা করে আবার জোড়া দেয়া হচ্ছে। কেউ সাপ বিচ্ছু খাচ্ছে। এরকম হাজারো ধরনের শাস্তি দেখতে দেখতে এক জায়গায় তাঁরা দেখেন এক টগবগে ফুটন্ত কড়াইতে কিছু মানুষ ভাজা হচ্ছে। সেখানে কোনো পাহারাদার নেই, তাদের কেউ কেউ কষ্ট করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। অনেক কষ্টে কেউ কেউ যখন বেরিয়ে পড়ার অবস্থায় আসছে তখন নিচ থেকে টেনে আবার ফুটন্ত কড়াইতে ফেলে দিচ্ছে। এটা কয়েকবার দেখে আবুল মনসুর আহমেদ তাঁর সঙ্গের পরিদর্শকদের বলেছিলেন, ‘এরা সব আমার ময়মনসিঙ্গা। এরা নিজেরাও ওপরে উঠবে না, কঠোর পরিশ্রম করে কেউ যদি ওপরে ওঠার চেষ্টা করে তাকেও এমন করে টেনে নামায়।’ মমতা ব্যানার্জির কায়কারবার দেখে কেন যেন আমার আবুল মনসুর আহমেদের কথাটি মনে পড়ে গেল।
শ্রী প্রণব মুখার্জি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার জন্ম বীরভূম জেলার কির্নাহার গ্রামে। পিতা কামদা কিংকর মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ দশ বছর কারানির্যাতন ভোগ করেছেন। ’৫২ থেকে ’৬৪ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন। শ্রী প্রণব মুখার্জি রাজনীতিতে শরিক হবেন, রাজনীতিবিদ হবেন, তাঁর স্কুল-কলেজ জীবনে তেমন বোঝা যায়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শ্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় ৩৫-৩৬ বছরের। কত স্মৃতিকথা শুনেছি। দুর্গাপূজায় তাঁর গ্রামের বাড়ি কির্নাহার এবং তাঁর দিদি অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়িতে গেছি, থেকেছি, খেয়েছি। তাই বলছি তাঁর মা ছেলেবেলায় কোনো কিছু আনতে যখন তাঁকে পয়সা দিতেন আমার মতো সেখান থেকে তিনি কিছু কিছু বাঁচাতেন। এটা কী করে করতেন সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করায় খুব গর্ব করে বলেছেন, ‘মা তো আমাকে জিনিস আনতে পাঠাতেন, সে হিসাবেই পয়সা দিতেন। পরিমাণটা তো ঠিক করতাম আমি।’ যেমনটা ছোটবেলায় বাজার করতে গিয়ে বছরের পর বছর আমিও করেছি। সে কারণে মা’র হাতে মার না খেলেও বাবা, বড় ভাইর হাতে প্রচুর মার খেয়েছি। প্রায় একশ’ ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর গৌরবের ধন যিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন তিনি আমার মতো মার খেয়েছেন কিনা এটা বলি কী করে। শ্রী প্রণব মুখার্জি একেবারে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন। ক্লাস ওয়ান থেকে টু-তে উঠেছিলেন। তারপর অনিয়মিত বা বাড়াবাড়িতে হেডমাস্টার খুব বিরক্ত হয়েছিলেন, তাকে স্কুলেই রাখবেন না। কিন্তু কামদা কিংকর মুখোপাধ্যায় একজন সংগ্রামী দেশপ্রেমিক ব্রিটিশবিরোধী নেতা হওয়ায় ভীষণ লোকপ্রিয় ছিলেন। একদিন হেডমাস্টারের কাছে শ্রী মুখার্জিকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তোকে তো আমি স্কুলে রাখবই না, তবু যা যা প্রশ্ন করব যদি উত্তর দিতে পারিস তাহলে ভেবে দেখব রাখা যাবে কি যাবে না।’ মাস্টারমশাই খুব রেগেমেগে প্রশ্ন করা শুরু করেন। প্রশ্ন করতে করতে তাঁর সব প্রশ্ন ফুরিয়ে যায়। আর ছোট বালক পল্টু অবলীলায় সব উত্তর দিয়ে দেয়। হেডমাস্টার তাজ্জব বনে যান। ক্লাস ওয়ান থেকে তাঁর প্রমোশন হয়। টু-থ্রি-ফোরে নয়, একেবারে ফাইভে। তারপর তাঁর লেখাপড়া নিয়ে আর আলোচনা না করাই ভালো। কৃতিত্বের সঙ্গে ডবল না ট্রিপল এমএ পাস করেন। তবে কখনও অর্থনীতি পড়েননি।
অথচ ভারতের সফল অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি খ্যাত। সারা পৃথিবীর একসময় শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অর্থশাস্ত্রের ছাত্র। তার অনুকূলে ওই অমূল্য পুরস্কারটি জোটেনি। জীবন শুরু করেছিলেন মাস্টারি দিয়ে। কয়েকদিন সংবাদপত্রেও লেখালেখি করেছেন। মন বসেছিল কিনা বলতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ল পড়ার সময় রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন এবং বাংলা কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। বাবার নামের জোরেই হয়তো বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে ’৬৯ সালে রাজ্যসভার সদস্য হয়ে দিল্লি যান। কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মূল কংগ্রেস নেতাদের বিরোধ বাধে। শেষ পর্যন্ত এরকম একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইন্দিরাজি সমর্থন করেন নির্দল প্রার্থী বরাহগিরি ভেঙ্কটগিরি মানে ভি ভি গিরিকে। কে কামরাজ, নিজলিংগাপ্পা, এস কে পাতিল, মোরারজি দেশাই, অতুল্য ঘোষের কংগ্রেস সিন্ডিকেট মনোনীত প্রার্থী ছিলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। সেই সময় শ্রী প্রণব মুখার্জি ইন্দিরাজির সঙ্গে থেকে যান। সেই থেকেই ইন্দিরাজির চোখের আলো হয়েছিলেন, এখনও দিল্লি আছেন। মাঝে ’৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী হন শ্রী রাজীব গান্ধী। অরুণ নেহেরু, কাশ্মীরের মাখন লাল ফোতেদার, অর্জুন সিং ও অন্যদের ষড়যন্ত্রে শ্রী প্রণব মুখার্জি ও এবিএ গনি খান চৌধুরী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন এবং ’৮৬ সালে প্রণব মুখার্জিকে কংগ্রেস ছাড়তে হয়। আবার কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর যোগ্যতার কারণেই তাকে অনেক বলে-কয়ে দলে নেয়া হয়। তিনি হন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। কতজন যে কতভাবে তাঁকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেছে। আবার অনেকের দোয়া ভালোবাসাও পেয়েছেন। বেশ কয়েকবার সরাসরি লোকসভা নির্বাচনে জিততে না পারায় নিন্দুকেরা যে কত নিন্দা করেছে। দু’চার জায়গায় ব্যক্তিগতভাবে ওসব শুনে আমার নিজেরও খারাপ লেগেছে। কিন্তু মালদা-মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর থেকে বিপুল ভোটে প্রথম লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে ইউপিএ সরকার গঠন করে সেই অপবাদ থেকে রেহাই পান। আবার দ্বিতীয়বার তার চাইতেও বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ হয়েও যখন চির তরুণের মতো কাজ করে চলেছিলেন, ঠিক তখনই তার সামনে এলো মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদের হাতছানি। তিনি যেই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি হবেন, জঙ্গীপুরের ভোটাররা তাদের প্রিয় প্রতিনিধি হারাবেন। নতুন কাউকে ওখান থেকে নির্বাচিত হতে হবে। জীবনের প্রায় বেশি সময় যে লোকসভা রাজ্যসভা তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, শ্রী মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হলেও রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায় শ্রী প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী না হয়েও লোকসভার নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দুর্লভ সুযোগ এবং সম্মান খুব বেশি মানুষের ভাগ্যে জোটে না। এইসব মধুময় স্মৃতিবিজড়িত সারাজীবনের বিচরণভূমিতে আর যখন তখন যেতে পারবেন না। ৩০০ কক্ষের বিশাল রাষ্ট্রপতি ভবন হবে আর ক’দিন পরেই তাঁর সার্বক্ষণিক বিচরণভূমি। তবুও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে শ্রী প্রণব মূুখার্জি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইউপিএ কর্তৃক মনোনীত এবং অন্যদের সমর্থন পাওয়ায় খুবই আনন্দ ও গর্ববোধ করছি। শুধু ব্যক্তিগত পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার কারণে নয়, একজন বাঙালি হিসেবে সব অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করছি বাঙালির এ গৌরব। আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সীমানায় নোবেল পুরস্কার অর্জন করে যে গৌরব এনে দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাঙালি হিসেবে নোবেল অর্জন করে বাঙালি জাতিকে যে পরিমাণ মহিমান্বিত করেছেন আমাদের মানিকগঞ্জের আরেক সন্তান বিশ্ব নাগরিক অমর্ত্য সেন, দিল্লির রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করে তেমনই আমাদের গর্বিত করতে চলেছেন শ্রী প্রণব মুখার্জি।
শ্রী প্রণব মুখার্জি জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মানুষ হলেও শ্রীমতী শুভ্রা মুখার্জি আমাদের বাংলাদেশের যশোরের মেয়ে। স্রষ্টার প্রতি তাঁর যে গভীর আস্থা দিল্লির মিলিটারি হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায় দেখেছি আজ তা আবার দেখলাম নতুন করে। হাসপাতালে দেখতে গেলে আমাকে বলেছিলেন, ‘বাঘা, কখনও দুশ্চিন্তা করো না। সবকিছু কপাল।’ গত দু’তিন দিন জি- নিউজের কল্যাণে বার বার যখন শ্রীমতী শুভ্রা মুখার্জি কপালে হাত দিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তখন স্রষ্টার প্রতি তাঁর গভীর বিশ্বাস দেখে আমার মন প্রাণ কানায় কানায় ভরে উঠছিল। তাদের একমাত্র কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখার্জি মুন্নীর অনুভূতি শুনেছি। কিন্তু পুত্র অভিজিত্ মুখার্জির কোনো প্রতিক্রিয়া শুনিনি। আশা করতে পারি সবাই খুশি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণ, পরিবার-পরিজন এবং আমার পক্ষ থেকে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হওয়ায় তাঁকে অগ্রিম অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাচ্ছি। পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে কায়মনে প্রার্থনা করি তিনি যেন একশ’ ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর সঙ্গে সারা দুনিয়ার ৪০ কোটি বাঙালির কল্যাণ করতে পারেন। সেইসঙ্গে সারাবিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে পরম দয়াময় আল্লাহ যেন তাঁকে কবুল ও মঞ্জুর করেন, আমিন।

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

আমার প্রতি এত আক্রোশ কেন?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম


বঙ্গবন্ধুর ট্যাবলেট খেয়ে আজও তার মালা জপি। তার হত্যার প্রতিবাদে যৌবন খুইয়েছি, তারপরও আমি হলাম শত্রু। আর যারা একসময় তার গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানাতে চেয়েছে তারা বন্ধু। তাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দু-একটি নিয়ম এবং অনিয়ম সম্পর্কে আমার অনুভূতি পাঠকদের কিছুটা অবহিত করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ১০ জুন জাতীয় সংসদে গাজী গোলাম দস্তগীরের আমার ২০/৩০ বাবর রোডের বাড়িতে বসবাস নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে পূর্ত প্রতিমন্ত্রী অবৈধ দখলদার হিসেবে আমার নাম উল্লেখ করায় এ সম্পর্কে দু'কথা না বলে পারছি না। তাই ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউ নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব।

যা বলতে ইচ্ছা হয় না, ভালো লাগে না, ইচ্ছার বাইরেও কিছু কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। স্বাধীনতার পর চাইলে মতিঝিল, ধানমন্ডি, বনানীর বহু জায়গা পায়ের তলে রাখতে পারতাম। গুলশান, বারিধারা তখন তো ছিল জঙ্গল। কিন্তু বাস্তব হলো ঢাকা শহরে আমার এক শতাংশ জায়গাও নেই। '৭৩ অথবা ৭৪ সালে বাবা-মা, ভাই-বোনের নামে কচুক্ষেতে আটটি সাফ কবলা দলিলে ৫২ শতাংশ জমি কিনেছিলাম। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সে জমির খাজনা-খারিজ সবকিছু থাকার পরও তা হাতছাড়া হয়ে আছে। অন্যদিকে সরকারিভাবে ঢাকা তো দূরের কথা, সারা দেশে আমার নামে এক অযুত শতাংশ জমি বা অন্য কিছু মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমাকে দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পরপরই একটি গাড়ি, বাবর রোডের বাড়ি, টেলিফোনসহ ওই সময় বিশেষ বিবেচনায় প্রতি মাসে ছয় হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয়েছিল। তখন বয়স ছিল কম, বুঝতাম আরও কম। তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। শেষ দিন পর্যন্ত ঘামাতেও চাইনি। কিন্তু পাপ ছাড়ে না বাপেরে, তেমনি কেন যেন বর্তমান সরকার, সরকারি দলের লোকেরা কোনোমতেই আমাকে ছাড়তে চায় না। আমি থাকি, আমার সন্তান সন্ততিরা বেঁচে থাকুক_ তাও বোধহয় চায় না। তা না হলে অনেক প্রবঞ্চক ভণ্ড যাদের দেশের জন্য কোনো ভূমিকা নেই তারা দেশটা লুটেপুটে খাচ্ছে, আর আমি শুধু বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু খাদ্যের প্রয়োজন, মাথা গোঁজার জন্য ঠাঁই প্রয়োজন সেটুকুও পাব না এটা কেমন কথা? আজ যারা ধনবান, গুলশান বারিধারায় বড় বড় বাড়িতে থাকে তারা অনেকেই স্বাধীনতার পর বাবর রোডের এই ভাঙা বাড়িতে মাসের পর মাস ধরনা দিয়েছে। গত ১০ জুন সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীর ঢাকায় কতগুলো অবৈধ দখলদার আছে জানতে চেয়েছেন। স্বাধীনতার পর এই শহীদ-গাজীরা কী অবস্থায় ছিলেন তা সবার জানা। মাত্র ছয়-সাত বছর আগেও বিটিআরসির লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ৫০-৬০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও কোনো কাজ না হওয়ায় আমার এক শিষ্যকে ধরেছিলেন। আমি মার্গুব মোরশেদকে গিয়ে বলায় এক কথায় তিনি লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এক পয়সাও যেমন আমাকে দিতে হয়নি তেমনি মার্গুব মোরশেদকেও নয়। মাত্র ক'দিন আগে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রূপগঞ্জ-বেলাবোর হাউজিংয়ের জমি নিয়ে কত কেলেঙ্কারিই না করেছেন। তবে হ্যাঁ, ২০/৩০ বাবর রোডের বাড়িতে নিশ্চয়ই আমি তাদের ভাষায় অবৈধভাবে আছি। তাই আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা না করে আগামীকাল বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলে আইনের আশ্রয় নেব, কোর্ট যেদিন বলবে আমি অবৈধ, ২০/৩০ বাবর রোডে থাকার আমার কোনো অধিকার নেই, সেই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে দেব। কোনো উচ্চ আদালতে আপিল করতেও যাব না। কারণ এখন এপার থেকে যাওয়ার সময়। এপারের অনেক লীলাখেলা দেখেছি, আর নয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভারতে থাকতে আমার সঙ্গে কথা বলতে কতবার আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছেন, এখন কথা বলা যাবে? ওর মন মেজাজ ঠিক আছে তো? আর ক্ষমতায় বসে তিনিই আজ পরিবারসহ আমাকে পিষে মারতে চান। আল্লাহ রক্ষা করলে কে কাকে পিষে মারবে? হ্যাঁ, আমি মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি, বাবর রোডের বাড়ি আমি দখল করিনি। এ বাড়িটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২২ অথবা ২৪ মার্চ দখল করে আমাকে বসিয়ে গেছেন। যদি ২০/৩০ বাবর রোডের বাড়ি দখলের কৃতিত্ব কারও থেকে থাকে তা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এ জন্য প্রশংসা, নিন্দা দুটোই তার প্রাপ্য। এ ক্ষেত্রে আমি সম্পূর্ণ লাচার, আমার কোনো ভূমিকা নেই। মুক্তিযুদ্ধ করে এদেশের নাগরিক হিসেবে মোহাম্মদপুরের মতো অস্বাস্থ্যকর জায়গায় পাঁচ কাঠা জমির ওপর আমি যদি একটি বাড়ি না পেতে পারি_ এতে এখন আর আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি ঢাকায় থাকতেও চাইনি। যদি শত্রুরা গুম না করে তাহলে দেহটা কবরস্থ করার বাসনা ছাতিহাটি গ্রামে মসজিদের পাশে বাবা-মায়ের পায়ের তলে। আমার মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব আনা থেকে বিরত থাকতে আবেদন করেছি। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আমার পিতা-মাতার নামে কোনো শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। কারণ তারা সমাজসেবক বা সেবিকা ছিলেন না। জীবিতকালে অপমান-অপদস্ত ও অকথ্য নির্যাতন করে মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একেবারে মিসকিনের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখাতে অপ্রশিক্ষিত পুলিশ দ্বারা যে অন্তিম সালাম দেওয়া হয় সেটা দিতেও বারণ করেছি সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। যদি এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়ে থাকে, পরিপূর্ণ ইসলামী শরিয়ত মতো যদি একজন মুসলমানের অন্তিম ইচ্ছার মূল্য থাকে তাহলে সরকার কোনোমতেই আমার অন্তিম ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইসলামী শরিয়তের বরখেলাপ কিছু করবে না। মন্ত্রী উত্তরে বলেছেন, ২০/৩০ বাবর রোডের বাড়ি অবৈধ দখলে রেখেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। ২০/৩০ বাবর রোডে বসবাস করি এটা সারা দুনিয়ার মানুষ জানে। ইয়াসির আরাফাত, ব্রেজনেভ, এডওয়ার্ড হিথ, ফিদেল কাস্ত্রো, আনোয়ার সাদাত জানে, ভারত জানে, পাকিস্তান জানে, আমেরিকা জানে, ব্রিটেন জানে, জার্মান জানে, এমনি অনেক বিশ্ববরেণ্য নেতাও জানেন। এ কারণে জানে যে, তারা ১৯৭৫-এর আগে এবং ১৯৯০-এর পরে এই ঠিকানায় বহু চিঠি দিয়েছেন। '৭২ থেকে ২০/৩০ বাবর রোডে আমার নামে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন, পানির সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি '৭৩ সালের মাঠ জরিপে আমার নাম লেখা আছে। '৭৫-এ গভর্নর পদ্ধতি করা হলে ২০/৩০ বাবর রোড নামে আমার ঠিকানা গেজেটভুক্ত হয়েছে। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঢাকা ত্যাগ করলে বাবর রোডের যে সিজার লিস্ট করা হয়েছিল তাও ছিল আমার নামে। কয়েক বছর পর সরকার জিনিসপত্র আমার বোন রহিমা সিদ্দিকীর হাতে ফেরত দেওয়ার চিঠিতেও আমার নাম উল্লেখ আছে। এখনো বাবর রোডের সোফা, টি টেবিল মাননীয় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বাড়িতে রয়েছে। আমি দুবার এমপি হয়েছি। তার গেজেটও বাবর রোডের ঠিকানায়। '৯০-এর পর আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেখানেও আমার ঠিকানা ছিল ২০/৩০ বাবর রোড। হাইকোর্টে রিট করে যখন আমি মুক্তি পাই সেখানেও বাবর রোডের কথা উল্লেখ আছে। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা মানুষ পাঁচ কাঠা জায়গার ওপর বৈধভাবে এ দুনিয়ায় স্থান পেলাম না তাতে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু পরপারে যাওয়ার পথে সাড়ে তিন হাত মাটি পেলেই হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এতকিছুর পরও কেন জানি আপনার অকল্যাণের কথা চিন্তায় আসে না। কিন্তু বয়স যখন হয়েছে তখন তো এটা নিশ্চয়ই বুঝি আপনার পূর্বানুমতি ছাড়া কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে আপনার দলের কারও কোনো কিছু বলা তো দূরের কথা, তাদের অনেকের মৃত বাপ-দাদারও সাধ্যের অতীত। আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আমিও তো বাংলাদেশের একজন নাগরিক। আমার একটি ছেলে, একটি মেয়ে আর একটি শিশুকন্যা আল্লাহতায়ালার দান। আমার একজন খুবই সাদামাটা স্ত্রী আছে। আমাদের ওপর কেন আপনার এত আক্রোশ? আমি আপনার গোলাম হতে পারিনি তাই এত রাগ? আমি তো আপনার ভাই ছিলাম, এখনো আছি। আমাকে কেন চাটুকার, গোলাম বানাতে চেষ্টা করবেন? আওয়ামী লীগের জন্য এত পরিশ্রম করার পরও আমি যেদিন আওয়ামী লীগ ছেড়েছি সেদিন তো আপনাদের একটি চেয়ার-টেবিলেও ভাগ বসাতে যাইনি। দীর্ঘদিন ঘর-সংসার করা কোনো অভাগা স্ত্রীকে স্বামী বাড়িছাড়া-সংসারছাড়া করলে যেমন হয়, যেমন খ্যাতিমান সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ করেছেন, আমার ক্ষেত্রেও খুব একটা ব্যতিক্রম হয়নি। আমি একা মানুষ। আপনারা ক্ষমতাবান সবাই একত্র। আমি কি-ইবা করতে পারি। আপনাদের সঙ্গে মতে মেলেনি, পদত্যাগ করেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম। কত চোর-ডাকাতকে যে পাঠিয়েছিলেন তা তো আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করুন। চিটাগাংয়ের জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু অনেক সম্পদশালী হয়েও ক্যান্সারে অকালে মারা গেছে। সেও ভোট চুরি করতে গিয়েছিল। আপনার উপদেষ্টা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার যাকে ভারতে বছরের পর বছর আর্থিক সাহায্য না করলে না খেয়ে মরত, সেও চোরের দলে শামিল হয়েছিল। আপনি খুব ভালো করেই জানেন '৯৯-এর ১৫ নভেম্বর সখিপুর-বাসাইল উপ-নির্বাচনে জিতেছেন না হেরেছেন? '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ওই সময় আমি সখিপুরে না গেলে আপনার বর্তমান এমপি শওকত মোমেন শাহজাহানকে তার বাবা মোক্তার আলী চেয়ারম্যান, মান্নান তালুকদার, বাদশা তালুকদার, হিম্মত তালুকদার ও অন্যরা আর এক বা দুদিন পর টাঙ্গাইল নিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে সঁপে দিয়ে পাকিস্তান রক্ষার জন্য বীর সিপাহী বানাত। মুসলিম লীগ ঘরানার সন্তান তাকে আপনি কোটি কোটি অবৈধ টাকা জোগান দিয়ে শুধু আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ভোটচোর এমপি বানিয়েছেন। ভোট ডাকাতির প্রতিবাদ সভার প্রতিবাদে ১৮ নভেম্বর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে বসিয়ে রেখে আমাকে যুদ্ধাপরাধী বলে গালাগাল করেছে। যে কারণে আপনাদের কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে এখন আর যাই না। একবার কি ভেবে দেখবেন আমি যুদ্ধাপরাধী হলে আমার রাজনৈতিক পিতা আপনার জন্মদাতা জাতির জনক কী হয়? আর আমি যুদ্ধাপরাধী হলে গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী যুদ্ধাপরাধী হয় কি করে? কারণ আমরা দুই মেরুর। যেহেতু ওই কথা বলার জন্য এখনো তার কোনো শাস্তি হয়নি, সেহেতু মনে করাই যায় কথাটা শাহজাহান বলেনি, তাকে দিয়ে বলানো হয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর '৯৯ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে আমরা একটি মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছি। কী প্রয়োজন ছিল সেখানে গুণ্ডা-তস্করদের লেলিয়ে দিয়ে ১০৩ নিরীহ মানুষকে আহত করার? বাংলাদেশে রাজনীতি করা কি নিষিদ্ধ? বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের? তাহলে অমন করলেন কেন? পাঁচ কাঠা জমির ওপর ১৯৬২ সালে নির্মিত ছোট্ট একটি খুপড়ি বাড়িতে অবস্থান করি। লোকজনকে ঠিকমতো জায়গা দেওয়া যায় না। কাগজপত্র, বই-পুস্তক ঠিকভাবে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই জায়গাটুকুও সহ্য হয় না? আপনি তো গতবার ১১ একর জমির ওপর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা মূল্যের গণভবন লিখে নিয়েছিলেন। রেহানার নামে ধানমন্ডিতে দুই বিঘা না দুই একরের বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন। দেশের জন্য, দেশবাসীর জন্য সত্যিকারেই বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, কী অবদান আছে তার? আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রধান। অনেক কষ্ট করে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন। তাই আপনি এখন দেশের মালিক-মোক্তার। আপনিই বুকে হাত দিয়ে বলুন তো দেশ সৃষ্টিতে আপনার ভূমিকা কি? আপনি তো তখন ভাগিনা জয়কে পেটে নিয়ে বড় উৎকণ্ঠায় হানাদারদের হাতে বন্দী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবার, তার বাসস্থান হেফাজতের জন্য আইন পাস করেছেন। আপনার টার্ম শেষ হওয়ার আগেই হয়তো আবার গণভবন লিখে নেবেন। মন চায় না সমস্ত অস্তিত্ব বিদ্রোহ করে। তারপরও বাস্তবতা বলে দেশ কি শুধু আপনার বাবাই স্বাধীন করেছে, আমাদের কোনো ভূমিকা নেই? আপনি প্রধানমন্ত্রী_ আপনার বোন, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন এমনিতেই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবলয়ের আওতাভুক্ত। আমাদের জীবনের নিরাপত্তার কি কোনো প্রয়োজন নেই? একবার কি ভেবে দেখেছেন? আপনার বাবা জাতির পিতা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমাকে বাবর রোডের বাড়ি দিয়েছিলেন। আপনার সঙ্গে মতের অমিল হয়েছে বলে সেই বরাদ্দ অস্বীকার করছেন। অথচ আপনার কত চাকর-বাকর-ভৃত্যদের সরকারি বাড়ি দিয়েছেন। এক নিঃশ্বাসে ৫০ জনের নাম বলে দিতে পারি। অন্যদিকে বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের স্ত্রী আমার ভাবী, তিনিও কম যান না। কত আলানি-ফালানিকে সরকারি জমিজমা, বাড়িঘর দিয়েছেন। নিজেও ১৬৮ কাঠা জমির ওপর দুটি ফুটবল মাঠের সমান বাড়িতে ছিলেন। যেখান থেকে বড়বেশি অসম্মান করে তাকে বাড়িছাড়া করেছেন। তার সময়ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের সার-সংক্ষেপের ফাইল তার দফতরে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বয়স হয়েছে, তাই অনেক কিছু বোঝার শক্তিও আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সারা দেশে এক ছটাক জায়গা পাইনি। যে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রথম অস্ত্র নিয়েছেন আপনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই কাদেরিয়া বাহিনীর জাদুঘরের জন্য এক ছটাক জায়গাও পাওয়া যায়নি। অথচ আপনার নেক বান্দারা মুক্তিযুদ্ধ না করেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নামে জায়গা পেয়েছে, টাকা পেয়েছে, নানা জায়গা থেকে নানা রংয়ে-ঢংয়ে অনুদান পেয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। কিন্তু যেহেতু আপনার সঙ্গে আমার মতের গরমিল সে কারণে সুবিধাভোগীরা সুবিধা লুটছে। এমনটাই হয়। রোম যখন পুড়ে নিরো তখন বাঁশি বাজায়। আপনি বাজাবেন না কেন? বাজান। আমি দুবার এমপি হয়েছি। ঢাকায় কোনো প্লট পাইনি। ২০ বা ৩০ লাখ টাকায় গুলশানে ২৬০০ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিল। অত টাকা ছিল না আর দেমাকও ছিল জমি চেয়ে ঘর নেব কেন? আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী বর্তমানে মন্ত্রী। '৭০ ও '৭৩-এ এমপি ছিলেন। তিনি প্লট পেয়েছেন। আমার ভাবী '৮৬-তে স্বতন্ত্র এমপি হয়েছিলেন। তিনিও প্লট পেয়েছেন। আমার দলের এক সময়ের সেক্রেটারি ফজলুর রহমান এমপি হিসেবে উত্তরায় প্লট পেয়েছেন। এখনো যারা এমপি হয়েছেন তাদের অনেকেই প্লট পেয়েছেন এবং পাবেন। নামগোত্রহীন এক দলের এক নেতা শিল্পমন্ত্রী তিনি। তার বউ-পোলাপান চৌদ্দ গোষ্ঠী সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় কী সব দেখছি। তারা সবাই বৈধ শুধু আমি অবৈধ। আসলে আগে বুঝতাম না, এখন বুঝি। এসবই ভাগ্যের ফের। ন্যায়-নীতি আদর্শের কোনো বালাই নেই। পক্ষে থাকলে ভালো, সত্য বললেই খারাপ। এই ক'দিন আগে মহামান্য হাইকোর্ট তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্লট নিয়ে রুলিং জারি করেছেন। হঠাৎই সেদিন দেখলাম যায়যায়দিনের অফিসের প্লট কয় একর হবে আল্লাহই জানেন। কামরুল ইসলাম, জিয়াউল হক প্রত্যেকের নামে প্লট। বামপন্থি নেতা রাশেদ খান মেনন একটি আবাসিক, আরেকটি বাণিজ্যিক প্লট পেয়েছেন। আসলেই তারা কি মুক্তিযুদ্ধে এবং পরে আমার চেয়ে খুব বেশি ক্ষমতাবান ছিলেন? সবার জন্য ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, বনানী, তেজগাঁও এলাকায় বিঘা বিঘা জমি সহ্য হয় আর জেনেভা ক্যাম্পের পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাবর রোডের পাঁচ কাঠা জমি আমার জন্য সহ্য হয় না- ভাবতেই অবাক লাগে। যাক আর কথা বাড়াতে চাই না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র দখল করা বাড়ি যদি অবৈধ হয় আলহামদুলিল্লাহ। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব। তবে সেইসঙ্গে দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন রাখব- নব্য ধনবান সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীর পদের গরমে এমন প্রশ্ন করতেই পারেন। কিন্তু মন্ত্রী মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিয়ে এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ শপথ ভঙ্গ করেছেন। কারণ তার মন্ত্রণালয় আমাকে স্পষ্ট করে জানিয়েছিল _ আপনার নামে এক হাজার এক টাকা প্রতীকী মূল্যে ২০/৩০ বাবর রোডের বাড়ি বরাদ্দ দানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপনার এবং আপনার ওপর নির্ভরশীল পোষ্যদের ঢাকায় আর কোথাও সরকারি বরাদ্দের জায়গা আছে কিনা এই মর্মে আপনার একটি হলফনামা প্রয়োজন। হলফনামা পেলেই আমরা আপনার অনুকূলে ওই বাড়িটি বরাদ্দের সাফ কবলা দলিল স্বাক্ষর করতে পারি। আজ থেকে সাত-আট বছর আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করায় আমি অপরাধ করেছি, নাকি সরকার অমার্জনীয় অপরাধ করেছে? এ বিচারের ভার দেশবাসীর ওপর ছেড়ে দিলাম। আমি ভালো করেই জানি জনগণের হৃদয় থেকে আমাকে মুছে ফেলতে, তাদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে ষড়যন্ত্রকারীদের এই অশুভ প্রয়াস কোনোমতেই সফল হবে না।

লেখক : রাজনীতিক