শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

পিতাকে পুত্র

পিতাকে পুত্র


॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আজ ১৯ মে। দিনগুলো খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। পুরো মাসটাই বড় অশান্তিতে চলেছে। ক’দিন ধরে সরকারি দল বলছিল, দুই মামলাতেই কাতÑ ’৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর নামে আগরতলা মামলা দিয়ে আইয়ুব খানের চেলারা যেমনটা বলেছিল। ১৬ মে বিরোধী দলের সব নেতাকে কারাগারে ঢুকিয়েছে। সরকারি দলের সে কী উল্লাস! এবার কেল্লা ফতে। মনে হয় সরকার বা সরকারি দল ইচ্ছে করেই হরতালের রাস্তায় যাচ্ছে। তাদের ধারণা বিরোধী দলকে বারবার হরতাল দিতে বাধ্য করতে পারলে মানুষ তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। সরকারের যে এখানেও কিছু দায়িত্ব আছে এ নিয়ে তারা গা করছেন না। একবারো ভাবছেন না এক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান শেষ হয়েছে। তাই ইদানীংয়ের দুই মামলার কী পরিণতি হবে তা আল্লাহই জানেন। এসব বোঝাই কাকে? সবাই বড় বেশি বোঝে। লোকজন বলাবলি করছে, সুরঞ্জিৎ সেনের ঘুষ কেলেঙ্কারি ঢাকা দিতে ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। সারা দেশ সে জন্য খুবই উদ্বিগ্ন। ঘটনাটি ব্যক্তি, পরিবার কিংবা দেশীয় সীমানায় আবদ্ধ নেই। একেবারে আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে বলা হয়েছে। এমনকি ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর কান্না আকাশে-বাতাসে ভাসছে। তার সাত-আট বছরের ছোট্ট মেয়ের হিলারি কিনটনকে কাঁচা হাতে লেখা চিঠি কত ল কোটি মানুষের মনে দাগ কেটেছে। বাবা ছাড়া তার ছোট্ট ভুবন অন্ধকার। তার ঘুম আসে না। কে তার ছোট্ট ভুবন ভরিয়ে দেবে, নির্বিঘেœ ঘুমের গ্যারান্টি দেবে?
আজ অন্যের কথা ভাবার কেউ নেই। কেমন যেন নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত। রাষ্ট্র, সমাজ, সমাজপতিরা কেউ কারো কথা ভাবে না। আগে রাস্তাঘাটে কেউ আহত হলে তাকে সাহায্য করতে ভিড় জমে যেত। সে যেই হোক, কোনো রক্তাক্ত মানুষ কখনো রাস্তায় পড়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যেত না। এখন দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্ঘটনাই বেশি, ঘটনা কম। গত ১৬ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারীর হাসামদিয়া গিয়েছিলাম তোমার প্রিয় শাহ আবু জাফরের বাড়ি। তাকে খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী হাসামদিয়ার ৩৩ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে এবং পুড়িয়ে মেরেছিল, গিয়েছিলাম তাদের স্মরণসভায়। এখন রাস্তাঘাটে সে যে কী ঝকমারি তা বলার মতো নয়। যত রকমের সুব্যবস্থাই থাকুক না কেন, নিরাপদে রাস্তাঘাটে চলার উপায় নেই। মনে হয় দুই-আড়াই বছর যশোরের দিকে যাওয়া হয়নি। তাই আরিচা-নগরবাড়ী, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। যদিও এখন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। মাদারীপুরের শাজাহান খানের বাবা আসমত আলী খান তোমার এমপি ছিলেন। কিন্তু শাজাহান খান জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। অনেক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে গুম এবং হত্যা করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি এখন তোমার কন্যার নৌপরিবহনমন্ত্রী। আদতে পরিবহন শ্রমিক নেতা। এক দিকে যেমন কোনো কিছু ছাড়াই গাড়িঘোড়ার ড্রাইভারদের লাইসেন্স দিতে বলেন, অন্য দিকে অতি সম্প্রতি বরিশালে তার গাড়ির সাথে এক বাসের সংঘর্ষ হওয়ায় বাসচালককে ফাঁসি দিতে চেয়েছেন। গাড়ি দিয়ে অন্যকে হত্যা করলে, তার গায়ে-পায়ে লাগে না। নিজের গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ায় তিনি চালকের ফাঁসি চান, এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! কারো কোনো সহনশীলতা নেই। গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হলে চালকের ফাঁসি হবে কেন? আইনানুগ যতটুকু শাস্তি হওয়ার ততটুকুই হবে। আসলে আমাদের সড়কব্যবস্থা নিরাপদ নয়। যারা গাড়ি চালান তারা যে সবাই খারাপ তেমনও নয়। গাড়ি চালানোর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে কাউকে প্রশিণ দেয়া হয় না। গাড়ি চালাতে গিয়ে যে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে হয় তা বলার কেউ নেই। একজন চালকের হাতে যে কতগুলো মানুষের জীবন সেই বুঝটুকুও তাকে দেয়া হয় না। সামান্য একটু প্রশিণ দিলেই যেখানে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে, কিন্তু কেউ আন্তরিক নয়। সবই চলছে গদাই লস্করী চালে।
একবার ভেবেছিলাম ১৬ মে সকালে রওনা হয়ে সরাসরি বোয়ালমারীর অনুষ্ঠানে অংশ নেবো। আবার মনে হলোÑ না, ১৫ তারিখ রাতে ফরিদপুর গিয়ে থাকি। সেখান থেকে পরদিন খুব সহজেই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া যাবে। সেই হিসেবে ডিসি, এসপি ফরিদপুরকে চিঠি দিয়েছিলাম। তাই ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিলাম। রাস্তা বেশ ফাঁকাই ছিল। কিন্তু গাড়িতে গ্যাস ছিল না। সাভারের পর সাড়ে সাতটার দিকে এক সিএনজি স্টেশনে গিয়েছিলাম। স্টেশনের গার্ড প্রথম প্রথম খুব তারস্বরে বলল, ‘৯টার আগে কোনোক্রমেই গ্যাস দেয়া যাবে না।’ সহকর্মীরা গিয়ে স্টেশনের এক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ডেকে আনল। তাকে বললাম, ‘আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমরা ফরিদপুর যাচ্ছি। একটু গ্যাস হলে ভালো হয়।’ ভীষণ আন্তরিকতার সাথে তিনি আমাদের গ্যাস দিলেন। দু’গাড়িতে মাত্র ছয়-সাত শ’ টাকা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফিলিং স্টেশনটি কার?’ বললেন, ‘নাভানা গ্র“পের শফিউল ইসলাম কামালের।’ তিনি আমাদের বহু বছরের পরিচিত। একসময়ের বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ধনী জহুরুল ইসলাম বেঁচে থাকতে কত সময় কতভাবে সাহায্য করেছেন। প্রায় ৫০ বছর তারা আমাদের আত্মীয়ের মতো। এখন আগের মতো যোগাযোগ না থাকলেও সম্পর্ক ভালোই আছে। ফেরিতে আগেই বলে দেয়া ছিল। একে তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আমার এক সহকর্মী উল্লাপাড়া কলেজের ’৬৯-৭০ সালের ভিপি জলিল কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছিল জানি না। কিভাবে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের দৃষ্টি কেড়েছিল তাও জানি না। লেখাপড়া জানা তখনকার ভালো ছেলে এখন ভালো মানুষ বিআইডব্লিউটিসির সচিব। নানা সময় উত্থান-পতনের কথা ভাবে না, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মতোই ভাবে। সেই জলিলকে বলেছিলাম। তা ছাড়া সেই ’৯০ থেকে ফেরি পারাপারে অর্জুনের সারথী ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মতো আমাদের সারথী বিআইডব্লিউটিএ’র শ্রমিক নেতা নারায়ণগঞ্জের শুকুর মামুদ। মনে হয়, কয়েক বছর যাবৎ সরকারিভাবে অবসরে গেছে কিন্তু কর্মজীবনে তার অবসর নেই। তাকেও বলেছিলাম। তাই ফেরি পারাপারে ছিল এক রাজকীয় ব্যবস্থা। যাওয়ার পথে তরা সেতুতে এক মজার ঘটনা ঘটে। গত বিশ বছর তরা সেতুতে আমার কাছ থেকে কেন যেন পয়সা-কড়ি নেন না। কেন নেয় না তা বুঝি না। কিন্তু টোল কালেক্টর যারাই থাকেন ছোট-বড় যেই হোন কেউ পয়সা নেন না। তখন ছিল রাত আটটার মতো। খুব একটা ঝকঝকে আলোও ছিল না। হাত বাড়ালে পেছনের সিট থেকে পয়সা দিয়ে গাড়ি টান দিতেই টোল কালেক্টর চিনতে পেরে আচমকা বলে উঠলো, ‘ইস্! পয়সা নেয়াটা ভালো হলো না।’ আমরা ততণে চলে এসেছিলাম। পরদিন ফেরার পথে কোনো মতেই পয়সা দিতে পারিনি। তারা কিছুতেই পয়সা নেবেন না। আমি নাকি তাদের কাছে খুব সম্মানী। ফেরার পথে পয়সা না নেয়া চার-পাঁচজনের কলরব হৃদয়ে নাড়া না জাগালেও আগের দিনের ‘ইস্! পয়সা নেয়াটা ভালো হলো না’ আমাকে নাড়া দিয়েছিল।
দৌলতদিয়ার পাড়ে নেমে সে যে কী প্রচণ্ড ভিড়। কল্পনা করা যায় না। তবুও বেশ সহজেই বেরিয়ে এসেছিলাম। ঘাটপাড়ের কিছু লোকজন রাস্তা করে দিয়েছিলেন। রাত ১০টা ১০ মিনিটে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে পৌঁছে দেখি সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের ঘনিষ্ঠ কর্মী খন্দকার চান এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুস সালাম লাল বেশ কয়েকজনকে নিয়ে অপো করছে। এখন আর ফরিদপুর সার্কিট হাউজ আগের মতো নেই। নতুন নতুন বিল্ডিং তুলে সে যে কী অবস্থা করেছে ভাবাই যায় না। তোমার তো মনে থাকার কথা, ’৭৪-৭৫ এ তুমি যখন দেশের এক ইঞ্চিও মাটি পতিত না রাখতে আহ্বান জানিয়েছিলে, তখন এই সার্কিট হাউজের এক বয়সী পিওন ১৮০ মণ ধান উৎপাদন করেছিলেন সার্কিট হাউজের পতিত জমি আবাদ করে। ঘটনাটি পরের পর্বে তোমাকে মনে করিয়ে দেবো। সে যাই বলি আগের চেয়ে বিছানাপত্র, ফ্যান, এসি, টিভি সে এক এলাহি কারবার। রাতে খাবার খাইয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম লাল। রাতেই মেয়ে, ছেলের বউ, নাতি-নাতকুর নিয়ে এসেছিল। বাচ্চাগুলো বড় গোলমেলে। চেনে না জানে না, ‘দাদু দাদু’ বলে তোলপাড় করে ফেলেছিল। বাচ্চাদের বাচ্চার মতো করা ভীষণ ভালো লেগেছে। সকালে বিজনকুমার সাহা নামে ফরিদপুরের এক নিরীহ কর্মী এসেছিল। মনে আছে কি না কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তোমারও তাকে চেনার কথা। স্বাধীনতার পর ওকে বেশ কয়েকবার তোমার কাছে নিয়ে গেছি। ষাটের দশকে ওরা আমাদের পাড়ায় বাস করত। ওর দাদা নির্মলকুমার সাহা ছিলেন টাঙ্গাইলের জুট ইন্সপেক্টর। সেই সুবাদে ওদের সাথে আমার পরিচয়। বিজনকুমার সাহা সব সময় আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছিল। মুক্তিযুদ্ধে আমার সাথে থাকতে পারেনি বলে ওর ভীষণ দুঃখ ছিল। তাই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তুমি নিহত হলে আমি যখন এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করি তখন সে কত জায়গা ঘুরেফিরে আমাদের চান্দভুই ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হয়েছিল। মোরারজী দেশাই ও জিয়া সরকারের চুক্তি অনুযায়ী পুশব্যাক করা প্রতিরোধ সংগ্রামীদের মধ্যেও সে ছিল। হালুয়াঘাট, নরুন্দী, ময়মনসিংহ, লৌহজংয়ের কলাকোপা নির্যাতন ক্যাম্পসহ নানা কারাগারে কাটিয়ে একসময় মুক্তি পায়। ’৮১-তে তোমার কন্যা দিল্লি থেকে ঢাকা এলে তাকে দেখাশোনার জন্য হালুয়াঘাটের সালাম, আয়নাল, মানু, রেন্টু, সেন্টু, দুলাল ও এই বিজনকুমার সাহাকে দেয়া হয়। বিজনের গ্রামের বাড়ি মুকসুদপুর। গোপালগঞ্জ শহরেও ওদের বাড়ি আছে। দারুণ নিষ্ঠার সাথে প্রায় বারো বছর জননেত্রীকে এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি আগলে রাখে। কী দুর্ভাগ্য জানো, সেই বিজনকুমার সাহাকে তোমার কন্যা এখন চেনে না। আরো দুর্ভাগ্য গোপালগঞ্জ শহরে ওদের বাড়ির উঠানের ৯ ডেসিমাল জায়গা এনিমি বলে আওয়ামী লীগের পাণ্ডারা দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। কতজনের কাছে ছোটাছুটি করেছে কিন্তু কোনো প্রতিকার পায়নি। আমি নিজেও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা যিনি দেখাশোনা করেন সেই আলহাজ শেখ আবদল্ল­াহকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলাম কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আবদুল্লাহরা যখন মতাবান ছিল না তখন বড় ভালো ছিল। দ্বিতীয়বার আমি যখন তোমার কবরে যাই তখন শেখ আবদুল্লাহ কী যে যতœ করে তার বাড়িতে খাইয়েছিল, তার স্ত্রীর সে যে কী অসাধারণ রান্না, প্রায় আমার মায়ের মতো। মনে হয় তারা এখন হাওয়ায় আছে। কারো সুবিধা-অসুবিধা হৃদয় দিয়ে বিচার করে না। ফরিদপুর সার্কিট হাউজে বিজনকুমার সাহার মলিন মুখ দেখে বড় অশান্তি লেগেছে। বলে এসেছি, ধৈর্য ধরো অবশ্যই সব ঠিক হয়ে যাবে। বাকি কথা তোমাকে পরের পর্বে বলব। বোয়ালমারী শাহ জাফর টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের চমৎকার মাঠে তাপদাহের অনুষ্ঠানে অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে। এএইচ গ্র“পের আবুল হোসেন এবং তার স্ত্রী সুরভী হোসেন চামেলীর স্মরণসভায় বক্তৃতা আমার খুবই ভালো লেগেছে। এসব পরে বলছি। আগে আগের কথা বলে নিই।
তোমার মৃত্যুর পর কেন যে বলেছিলাম, ‘ বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র কামাল, জামাল, রাসেলকে খুনিরা হত্যা করতে পারলেও আমি কাদের সিদ্দিকী তার চতুর্থ পুত্র। পিতৃহত্যার বদলা আমি নেবোই নেবো।’ তার পরও চার-পাঁচ দিন ঢাকাতে ছিলাম। বড় খারাপ ছিল সেই দিনগুলো। প্রথম রাত জহুরী মহল্লায় মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান কুতুবের বোনের সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে। জায়গাটা খুব একটা নিরাপদ মনে হয়নি। তাই পরদিন দাদু মোহাম্মদ মোদাব্বেরের গজনবী রোডের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কথা ছিল তার পাশে ডলদের বাড়িতে কখনো গিয়ে উঠব। ডলের বাবা-মা সারা রাত জেগে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি। তাদের সে রাতের কষ্টের কথা মনে হলে আজো বড় কষ্ট হয়। আবার আনন্দও পাই এই ভেবে যে, কত আপনজন তুমি মরে যাওয়ার পর ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু ছোট বোনের বান্ধবীর বাবা-মা ওরকম দুঃসময় চরম বিপদের কথা জেনেও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিতে সারা রাত জেগেছিলেন। পরদিন গিয়েছিলাম ধানমন্ডির নিপ্পুদের বাড়ি। নিপ্পু টাঙ্গাইলের খোদাবক্স মোক্তারের মেয়ে। খোদাবক্স মোক্তার ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। তার মেয়ের জামাই বানিয়ারার কে জেড ইসলাম খোকন আমাদের আত্মীয়। ১৯৭৩ সালে জরুরি অবস্থার সময় মজুদবিরোধী আইনে তহবিল তসরুপের মামলায় একতরফা জেল হয়েছিল। আইনটি ছিল একেবারে জংলি। অনেকটা মানবতাবিরোধীও বলা চলে। সাীসাবুদ, আত্মপ সমর্থনের সুযোগ ছিল না। সেই সময় খোকন কিছু দিন আমার বাড়িতে পালিয়ে ছিল। তখন প্রশাসনে আমাদের যথেষ্ট সম্মান ও প্রভাব ছিল। তুমি ছিলে বলেই তা যে ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তুমি মারা যাওয়ার আগেই সেসব মামলা হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট করে মিটমাট করে ফেলে। তার বিপদের সময় আমাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল। তাই আমার বিপদে তার বাড়িতে আশ্রয় দিতে সে পাগল হয়েছিল। এক রাত ধানমন্ডির ১৯ নম্বর রোডের বাড়িতে ছিলামও। আমি চলে গেলে ছেলেমেয়ে নিয়ে মা ওখানে অনেক দিন ছিল। খোকনের বাসা থেকে গিয়েছিলাম জিগাতলায় গৌরাঙ্গীর আশরাফ গিরানীর খালাতো ভাই সিরাজগঞ্জের মোহনের বাসায়। মোহন কিছুটা অসুস্থ ছিল। এখন আর সে নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বেশ কয়েক বছর আগে পরপারে চলে গেছে। তার স্ত্রী খুব কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের বড় করেছে। মানুষ যে মানুষকে কত ভালোবাসতে পারে কোনো কোনো সময় কাউকে কাউকে না দেখলে তা বোঝা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা আমাকে পেলে টুকরো টুকরো করত। কেউ ধরে দিলে তাকে লাখ টাকা পুরস্কার দিত। ওই সময় তোমার খুনিরা পেলেও আদর করে চুমু খেত না। তারা কয়েক টুকরো বেশি করত। এমনিতেই আমি লম্বাচূড়ায় সাধারণ বাঙালির চেয়ে একটু বেশি। তার ওপর স্বাধীনতার পর লম্বা দাড়ি-চুল রাখায় সহজে সবাই চিনতে পারত। তাই ঠিক করা হলো ওগুলো কেটে ফেলা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দাড়ি-চুলে হাত পড়েনি। পরে পরিমাণমতো কাটা হতো। কিন্তু সে দিন দাড়ি-চুল কেটে একেবারে ছোট করে ফেলা হলো। বাইরের সুশীল এলে জানাজানি হতে পারে তাই আশরাফ গিরানী নিজেই কাঁচি ধরল। ঘাটাইলের গৌরাঙ্গীর আশরাফ গিরানী পেছনের একগোছা চুল কেটে অঝোরে কাঁদতে লাগল। দুলাল, লুৎফর, বাবুল হক ওরাও কাঁদছিল। ওদের কান্না দেখে মোহন আর মোহনের বউয়ের সে কী কান্না। মা-বাবাকে কাঁদতে দেখে ওদের বাচ্চাও আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। সারা বাড়িতে দাড়ি-চুল কাটতে নিয়ে সে এক হৃদয়বিদারক কান্নার রোল পড়ে গেল। অথচ কতটা নিষ্ঠুর হলে তোমার মতো পিতাকে গুলি করে হত্যা করতে পারে! গিরানী বোধহয় জীবনে কোনো দিন চুল কাটেনি। দাড়ি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। অনভ্যস্ত হলেও দাড়িগোঁফ সমান করে কেটে ফেলেছিলাম। চুল কাটাটা কেমন যেন উদ্ভট হয়েছিল। ও সময় তা নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু দাড়ি-চুল কাটা হয়ে গেলে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছিলাম না। ওতে একটু সাহস পেয়েছিলাম। নিজেই যখন নিজেকে চিনতে পারছি না তখন শত্র“রা চিনবে কী করে! কয়েক দিন থেকে চিন্তা করেছিলাম টাঙ্গাইল পাহাড়ি অঞ্চলে চলে যাবো। গত তিন দিন কারো সাথে দেখা হয়নি। শুধু শুশু ছিল একমাত্র ভরসা। ছোটবেলা থেকেই রহিমা বেশি কান্নাকাটি করত। তাই ওর সাথে দেখা হয়নি। যে মা চলনরহিত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন সেই মা একাই পিজি থেকে বাড়ি ফিরেছেন। আমি বেরোনোর পরই ২০-৩০ বাবর রোডের বাড়িতে জালেম ফারুক-রশিদের লেলিয়ে দেয়া খুনি বাহিনী এসেছিল। আমাকে না পেয়ে এটা-ওটা দেখিয়ে চটপট চলে গেছে। তখনো বিয়েশাদি করিনি। ভাইবোন-সহকর্মীরা কে কোথায় তার কিছু জানি না। একটা দম বন্ধ অবস্থা। জিগাতলায় একরাত কাটিয়ে এলাম ধানমন্ডি, ড. আর এ গনির বাড়িতে। আর এ গনির স্ত্রী এলি খালা। আমি যেমন এলি খালা বলে ডাকতাম, এলি খালাও আমায় কাদের মামা বলে ডাকতেন। সে জন্য খালার স্বামী আর এ গনিকে খালু না বলে মামা বলে ডাকতাম। এখনো ডাকি। তিনিও আমায় মামা বলে ডাকেন। এখন তিনি বিএনপির একজন বেশ বড়সড় নেতা। তারা তোমার পরে চার-পাঁচবার দেশ শাসন করেছে। জাতীয় পার্টি নামেরও দল আছে। তোমার সময় এসবের কিছুই ছিল না। শুনেছি একসময় ড. আর এ গনি বীরোত্তম জিয়াউর রহমানকে কোনো কিছু পরিয়ে ছিলেন তাই জিয়াউর রহমান তাকে খুবই সম্মান করতেন। যে কারণে দলের নেতাদের কাছে এবং বিএনপির কাছে এখনো সম্মান পান। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন