ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম

মে মাসের ৪, ৫ ও ৬ তারিখ ছিল বাংলাদেশের জন্য এক রাজনৈতিক সুনামি। ৪ তারিখ এলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ৫ তারিখ দুপুরে পরাশক্তিধর আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, রাত ৯টায় ভারতের বর্ষীয়ান নেতা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। সরকার এবং প্রধান বিরোধী দলের তত্পরতার শেষ ছিল না। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা ছিল অর্থনীতির ওপর। অর্থনীতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অবশ্যম্ভাবী হলেও আগ বাড়িয়ে কোনো উপদেশ দেননি। তবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে কড়কড়ে সত্য বলেছেন। বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাটি আগে মিটিয়ে ফেলা উচিত। জাপানের একার পক্ষে পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ অর্থ যোগান সম্ভব নয়। আমরা কেন যেন বোঝেও বোঝার চেষ্টা করি না। ভিক্ষা করে কি রাজরাজড়ার মেজাজ দেখানো সম্ভব? একেবারেই না। হিলারি ক্লিনটন মনে হয় ২০-২২ ঘণ্টা ছিলেন। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির আসার কথা চলছিল প্রায় দুই-তিন মাস থেকে। তাই হোটেল সোনারগাঁওয়ে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বহু আগে। শুনেছিলাম এক বনে দুই বাঘ থাকে না। এবার দেখলাম এক হোটেলে দুই দেশের মন্ত্রীও থাকে না বা থাকতে পারে না। কেন যে পৃথিবীর মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে—ব্যাপারটি কোনোমতেই মিলছে না। ইদানীং তো কূটনৈতিক খেলায় গোল দিলেও জিত, গোল খেলেও জিত। তা না হলে সমুদ্র সীমা বিজয়ের বাহানায় বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে বলে কত উত্সব হলো! অন্যদিকে যে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ তারাও আচ্ছা করে বিজয় দিবস পালন করল। যাক তবুও শান্তি সুস্থিতি বজায় থাকলেই হলো। তবে কূটনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ মনে করে আমেরিকা না আওয়ামী লীগ, না বিএনপির দিকে। কিন্তু ভারতে কংগ্রেস সরকার হলে চোখ-কান বুজে আওয়ামী লীগ। এইবারই প্রথম বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখার্জি একটা প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন। তা হলো কোনো দলের সঙ্গে নয়, ভারত চায় বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই যদি হয় তাহলে ভারতে যাওয়ার জন্য যে ভিসার গজব সেটাকে তো একটু সহজ ও সুন্দর করতে হবে। সীমান্তে ফেলানীদের যখন তখন গুলি করে মারা যাবে না। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে। সেই কবে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় পাঁচ লাখ টন চাল দেয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত এক ছটাকও দেয়া হয়নি। প্রায় দেড় বছর হয় একশ’ কোটি ডলার ঋণচুক্তি হয়েছে। তার এক টাকাও পাওয়া যায়নি। এরকম হলে তো কেউ কাউকে বিশ্বাস করবে না। বয়স তো আর কম হলো না। পাকিস্তান আমলেও রাস্তাঘাটে যতটা না ভারত বিদ্বেষ দেখা গেছে, বর্তমানে ভারতের প্রতি নতজানু সরকারের আমলে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি দেখা যাচ্ছে। কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখলে কোনো সমাধান হবে না। চোখ-কান খুলে নিরাসক্তভাবে সবকিছু দেখে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া তাও নাকি ভারতের কারসাজি। এই অঞ্চলের মানুষ যখন কোনো কিছু বলতে শুরু করে তা কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিদেশি নাগরিক গওহর রিজভী ও ড. মশিউর রহমান এতদিন জোর দিয়ে বললেন, তিস্তা চুক্তি হবে, পানির ন্যায্য হিস্যা পাব। এবার তো দিল্লি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে, এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কোনো অগ্রগতি না হলে তিস্তা চুক্তি সম্ভব না। আমাদের কী দুর্গতি। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে এতিমের মতো বসে থেকে একটি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। সামান্য মর্যাদাবোধ থাকলে ওখান থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র লিখে নিয়ে আসতেন। রাজস্থানের রাজপুত নারীদের সম্পর্কে শুনেছি, তাদের পুরুষরা কোথাও যুদ্ধে গিয়ে পরাজিত হলে শত্রুর হাতে পড়ে সম্ভ্রম হারাবেন আশঙ্কায় জহরব্রত পালন করে আত্মহত্যা করতেন। এই পৃথিবীতে এখনও অনেকে আছে, সম্মানের জন্য জীবন দেয়, আবার কেউ কেউ সামান্য লাভের জন্য সম্মান দেয়। যাক এখন আর মান-মর্যাদার কথা বলে কোনো লাভ নেই। তা না হলে কত তেল মর্দন করে, ফুলচন্দন দিয়ে মিসেস হিলারিকে বাংলাদেশে আনা হলো। সফর শেষ হতে না হতেই অর্থমন্ত্রী হাত-পা ছুড়ে কটমট করে যা বললেন, তা কিন্তু শাশ্বত বাঙালির কৃষ্টি-সভ্যতা নয়। আমাদের সভ্যতায় অতিথিকে কটুবাক্য প্রয়োগের নজির নেই, বরং অতিথির কটুবাক্য সহ্য করার বহু নজির আছে। নোবেল পাওয়ার জন্য ড. ইউনূসকে পছন্দ না হলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু তাই বলে জাতীয় ঐতিহ্য নষ্ট করতে হবে এটা কেমন কথা? অর্থমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় থেকেই সুবিধায় থাকতে থাকতে মনে হয় বেপরোয়া হয়ে গেছেন। তা না হলে একজন সম্মানিত বিদেশি অতিথি সম্পর্কে অমন বলতে অবশ্যই রুচিতে বাঁধতো। তিনি একক ব্যক্তি হিসেবে অমনটা করলেও গ্রহণযোগ্য হতো না। উপরন্তু রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে অমনটা করেছেন, তাই এ ব্যাপারে অবশ্যই তার জাতির সামনে জবাব দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সোচ্চার হতে আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা একটা চরম অস্বস্তিকর সময় অতিক্রম করছি। তাই সবার কাছে আশা করব, আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সামান্য সচেষ্ট হই তাহলে জাতির এই ক্রান্তিকাল অবশ্যই দূর হতে বাধ্য।
গত পর্বে ধানগড়ার নাজির হোসেনের স্ত্রীর ইন্তেকালের কথা লিখেছিলাম, এ ব্যাপারে আর একটু অগ্রসর হতে চাই। কারণ সেটা আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক কথা সেটা। তাই প্রিয় পাঠক, সেই প্রসঙ্গটা শেষ করে আসি।
বিকাল সাড়ে ৫টায় মোহাম্মদপুর থেকে রওনা হয়ে সাড়ে ৮টায় ধানগড়ায় নাজির হোসেনের বাড়ি পৌঁছি। আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো সেদিনও করটিয়া-টাঙ্গাইলে ব্যাপক ঝড়-তুফান হলেও এলেঙ্গার পর কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। কালিহাতীতে দেখলাম মেঘের ডাকাডাকি আছে কিন্তু একফোঁটা বৃষ্টি নেই। নাগবাড়ী থেকে ধানগড়া রাস্তা ভালো নয়। আগে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যেত না। নাগবাড়ী আবুল হাসান চৌধুরীদের বাড়ির সামনে একটা ছোট কালভার্টের কাজ হচ্ছে। পারাপার এমন দুর্গম করা হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। তবুও গাঁজার নৌকা যেমন পাহাড় দিয়ে যায় আমার গাড়িও তেমনি সব জায়গা দিয়েই যায়। ’৯০-এ গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে ফিরলে এদেশের একজন মহত্প্রাণ শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম ঢাকা মেট্রো ভ-৭৭০০ একটা ২৬০০ সিসির রকি জিপ আমায় উপহার দিয়েছিলেন। শুধু রকি জিপ নয়, সেই ’৬২-র পর থেকে আমৃত্যু কত হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন তার কোনো হিসাব নিকাশ নেই। কিন্তু কোনো দিন কোনো তদবির নিয়ে আসেননি। শুধু একবার বিএনপি সরকারের আমলে তাদের কয়েকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলে কয়েক মাস আওয়ামী লীগের মাসোহারা দিতে পারবেন না সেটা একটু জননেত্রীকে জানাতে অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া কোনো দিন আর অন্য কোনো কথা বলেননি। সেই গাড়ি দেশের কোনো আতর-বাতর, খাল-খন্দ, নদী-নালা নেই যেখানে যায়নি। এমনকি বুক সমান পানির মধ্য দিয়েও ধলেশ্বরী নদী পার হয়েছে। ইদানীংকালের গাড়িঘোড়া তেমন শক্তিশালী নয়। তবু আমি যে গাড়ি চালাই সে গাড়ি জানে হাইল্যা, জাইল্যার হাতে পড়লে কেমন হয়। তাই তেমন ওজর-আপত্তি করে না, সুড়সুড় করে সব জায়গা দিয়ে চলে। সেদিনও কাদা পানি ভেঙে আমাকে নিয়ে তাকে ধানগড়া যেতে হয়েছিল। নাগবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রানা সিদ্দিকী, বাংড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসমত আলী নেতা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বীর প্রতীক, টাঙ্গাইল জেলা সভাপতি এএইচএম আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলামসহ ৪০-৫০ জন সঙ্গে ছিল। আমি যখন ধানগড়া পৌঁছি তখন নাজির হোসেন জায়নামাজে ছিলেন। ঘরভর্তি মানুষ। এলাকার সবার কাছে আমি যেমন পরিচিত তারাও আমার কাছে। বাড়ির ছেলে মেয়েরা আমার সন্তানের মতোই। ও বাড়িতে আমার কত যে নাতিপুতি হিসাব মেলানো ভার। কারও দাদা, কারও নানা, ভাই, চাচা, মামা সম্পর্কের শেষ নেই। বছরে দু’একবার ধানগড়ায় যাওয়া হয়। সেদিন যে ঘরে গিয়ে বসেছিলাম ওখানেই ৪১ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ভাঙা ঘর ছিল। নাজির হোসেনের দু’হাত চেপে ধরে বুকে টেনে নিতে কত কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল প্রথম ওবাড়ি গিয়ে প্রায় বিশ-পঁচিশ দিন পর মা-বাবা, ভাইবোনদের দেখা পেয়েছিলাম। সেই সব স্মৃতি সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠা ছায়াছবির মতো একেক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী বীর বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত মা-বাবা, ভাইবোন টাঙ্গাইলেই ছিলেন। ২৫ মার্চ মাকে গ্রামের বাড়ি রেখে আসি। বাবা মোটরসাইকেল নিয়ে ছাতিহাটি টাঙ্গাইল ঘোরাফেরা করতেন। ৩ এপ্রিল যেদিন গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধ হয় সেদিন বাবা ছাতিহাটি গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার সময় মা-ই প্রায় একশ’জনের খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওর পরে কত পাহাড় ভর করেছি, সীমান্তের কাছে ফুলপুর থানার ওসি মমতাজ অবাঙালি বলে ১৪-১৫ জন সহকর্মীসহ একদিন বন্দি করে রেখেছিল। এরপর আবার ফিরে এসে আশ্রয়হীনভাবে কত জায়গায় ঘোরাফেরা করেছি। মাঝে মধ্যে মা-বাবা, ভাইবোনের কথা মনে হয়েছে। কেউ বাবাকে দেখেছে, কেউ ছোট ভাইদের। মনে মনে সান্ত্বনা পেয়েছি, ভেবেছি, রাস্তাঘাটহীন গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ভালোই আছেন। কিন্তু আমি মোটেই ভালো নেই। এক সময় আমরা অনেক ছিলাম। কিছুই করতে পারছি না বলে ৭-৮ দিন আগে সবাইকে বিদায় করেছি। কিন্তু সিলেটের ফারুক ও ইকবাল তখনও পিছু ছাড়েনি। দু’দিন পর সেই ইকবালকেও পিছু ছাড়া করেছি। সঙ্গে তখন শুধু একমাত্র ফারুক, ১৭ এপ্রিল দুপুরে উপলদিয়ার ফজলুদের বাড়িতে খেতে বসেছি। আমরা তখন সবাই মাটিতে পিঁড়িতে বসে খেতাম। ৬-৭ জনকে খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাত্ ফজলুর ছোট ভাই ১০-১২ বছরের রঞ্জু বলল, ‘মা, বজ্র ভাইর ছোট ভাই বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম।’ কথাটা শুনে কেমন যেন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। ‘বেল্লালকে তুই কোথায় দেখলি?’
— দেওপাড়ার কাছে।
— সত্যিই তুই দেখেছিস?
— হ্যাঁ, বেল্লালকে চিনব না?
— কথা বলেছিস?
— না, দুলাভাইয়ের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, তখন রাস্তা দিয়ে বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম। আমি আর সাহস করে এগিয়ে যাইনি।
বেল্লাল আমার থেকে চারজনের ছোট। তখন ওর আর বয়স কত— বারো-তেরো হবে। কান্নাকাটি আমাদের বাড়িতে নতুন কিছু নয়। একশ’জন মিলেমিশে কাঁদলেও আমার সমান হবে না। বাবার পিটুনি খেয়ে কেঁদেছি। বড় ভাইয়ের মার খেয়ে কেঁদেছি। মায়ের কাছে এটা-ওটা বায়না ধরে না পেয়ে কেঁদেছি। স্কুলে শিক্ষকদের বেত খেয়ে কেঁদেছি। ছেলেবেলায় আমার কাঁদার অন্ত ছিল না। কিন্তু তারপরও হঠাত্ করে ছোট ভাইয়ের কান্নার কথা শুনে বুক খান খান হয়ে গিয়েছিল। ভাত আর মুখে যাচ্ছিল না। কেমন যেন গলা শুকিয়ে আসছিল। তখনই ফজলুর মাকে বলে বিদায় নিয়েছিলাম। তিনি বিদায় দিতে চাননি তবুও নিয়েছিলাম। ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। চিরসঙ্গী ফারুক আর ফজলু ও রতনপুরের ফারুক এগিয়ে দিতে এসেছিল। ওদের বাড়ি থেকে প্রায় চার-পাঁচ মাইল পুবে নজরুলদের কাছতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এরপর দু’জন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সবচেয়ে দরিদ্র আত্মীয় ভোজদত্তের ফুপা মোকাদ্দেছ আলী খানের বাড়ী গিয়েছিলাম। আমাদের এই ফুপু গরিব হলেও আমাদের সবচেয়ে বেশি আদর-যত্ন করতেন। তার আদর ভালোবাসায় কোনো উজান-ভাটি দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই চরম দিনগুলোতেও না। এমনিতে তাদের দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা। কিন্তু তবু আমরা গেলে কী যে আদর-যত্ন করতেন। কোনো দিন মোরগ-মুরগি জবাই করে না খাইয়ে ছাড়তেন না। সেদিনও ছাড়েননি। বুঝতাম আমি তার ভাইয়ের ছেলে। তাই অত আদর। কিন্তু তখন যে প্রতিদিনই পাকিস্তান হানাদাররা আমার মাথার দাম লাখ টাকা ঘোষণা করে চলেছে। ধরে দিলেই লাখ টাকা পুরস্কার। আশ্রয় দিলে জীবননাশ। তারপরও তিনি ছাড়লেন না। ভাইপোকে খাওয়াতেই হবে। রাত ৯টার দিকে ছাড়া পেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটির দিকে রওনা হলাম।
(চলবে)
গত পর্বে ধানগড়ার নাজির হোসেনের স্ত্রীর ইন্তেকালের কথা লিখেছিলাম, এ ব্যাপারে আর একটু অগ্রসর হতে চাই। কারণ সেটা আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক কথা সেটা। তাই প্রিয় পাঠক, সেই প্রসঙ্গটা শেষ করে আসি।
বিকাল সাড়ে ৫টায় মোহাম্মদপুর থেকে রওনা হয়ে সাড়ে ৮টায় ধানগড়ায় নাজির হোসেনের বাড়ি পৌঁছি। আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো সেদিনও করটিয়া-টাঙ্গাইলে ব্যাপক ঝড়-তুফান হলেও এলেঙ্গার পর কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। কালিহাতীতে দেখলাম মেঘের ডাকাডাকি আছে কিন্তু একফোঁটা বৃষ্টি নেই। নাগবাড়ী থেকে ধানগড়া রাস্তা ভালো নয়। আগে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যেত না। নাগবাড়ী আবুল হাসান চৌধুরীদের বাড়ির সামনে একটা ছোট কালভার্টের কাজ হচ্ছে। পারাপার এমন দুর্গম করা হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। তবুও গাঁজার নৌকা যেমন পাহাড় দিয়ে যায় আমার গাড়িও তেমনি সব জায়গা দিয়েই যায়। ’৯০-এ গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে ফিরলে এদেশের একজন মহত্প্রাণ শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম ঢাকা মেট্রো ভ-৭৭০০ একটা ২৬০০ সিসির রকি জিপ আমায় উপহার দিয়েছিলেন। শুধু রকি জিপ নয়, সেই ’৬২-র পর থেকে আমৃত্যু কত হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন তার কোনো হিসাব নিকাশ নেই। কিন্তু কোনো দিন কোনো তদবির নিয়ে আসেননি। শুধু একবার বিএনপি সরকারের আমলে তাদের কয়েকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলে কয়েক মাস আওয়ামী লীগের মাসোহারা দিতে পারবেন না সেটা একটু জননেত্রীকে জানাতে অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া কোনো দিন আর অন্য কোনো কথা বলেননি। সেই গাড়ি দেশের কোনো আতর-বাতর, খাল-খন্দ, নদী-নালা নেই যেখানে যায়নি। এমনকি বুক সমান পানির মধ্য দিয়েও ধলেশ্বরী নদী পার হয়েছে। ইদানীংকালের গাড়িঘোড়া তেমন শক্তিশালী নয়। তবু আমি যে গাড়ি চালাই সে গাড়ি জানে হাইল্যা, জাইল্যার হাতে পড়লে কেমন হয়। তাই তেমন ওজর-আপত্তি করে না, সুড়সুড় করে সব জায়গা দিয়ে চলে। সেদিনও কাদা পানি ভেঙে আমাকে নিয়ে তাকে ধানগড়া যেতে হয়েছিল। নাগবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রানা সিদ্দিকী, বাংড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসমত আলী নেতা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বীর প্রতীক, টাঙ্গাইল জেলা সভাপতি এএইচএম আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলামসহ ৪০-৫০ জন সঙ্গে ছিল। আমি যখন ধানগড়া পৌঁছি তখন নাজির হোসেন জায়নামাজে ছিলেন। ঘরভর্তি মানুষ। এলাকার সবার কাছে আমি যেমন পরিচিত তারাও আমার কাছে। বাড়ির ছেলে মেয়েরা আমার সন্তানের মতোই। ও বাড়িতে আমার কত যে নাতিপুতি হিসাব মেলানো ভার। কারও দাদা, কারও নানা, ভাই, চাচা, মামা সম্পর্কের শেষ নেই। বছরে দু’একবার ধানগড়ায় যাওয়া হয়। সেদিন যে ঘরে গিয়ে বসেছিলাম ওখানেই ৪১ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ভাঙা ঘর ছিল। নাজির হোসেনের দু’হাত চেপে ধরে বুকে টেনে নিতে কত কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল প্রথম ওবাড়ি গিয়ে প্রায় বিশ-পঁচিশ দিন পর মা-বাবা, ভাইবোনদের দেখা পেয়েছিলাম। সেই সব স্মৃতি সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠা ছায়াছবির মতো একেক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী বীর বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত মা-বাবা, ভাইবোন টাঙ্গাইলেই ছিলেন। ২৫ মার্চ মাকে গ্রামের বাড়ি রেখে আসি। বাবা মোটরসাইকেল নিয়ে ছাতিহাটি টাঙ্গাইল ঘোরাফেরা করতেন। ৩ এপ্রিল যেদিন গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধ হয় সেদিন বাবা ছাতিহাটি গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার সময় মা-ই প্রায় একশ’জনের খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওর পরে কত পাহাড় ভর করেছি, সীমান্তের কাছে ফুলপুর থানার ওসি মমতাজ অবাঙালি বলে ১৪-১৫ জন সহকর্মীসহ একদিন বন্দি করে রেখেছিল। এরপর আবার ফিরে এসে আশ্রয়হীনভাবে কত জায়গায় ঘোরাফেরা করেছি। মাঝে মধ্যে মা-বাবা, ভাইবোনের কথা মনে হয়েছে। কেউ বাবাকে দেখেছে, কেউ ছোট ভাইদের। মনে মনে সান্ত্বনা পেয়েছি, ভেবেছি, রাস্তাঘাটহীন গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ভালোই আছেন। কিন্তু আমি মোটেই ভালো নেই। এক সময় আমরা অনেক ছিলাম। কিছুই করতে পারছি না বলে ৭-৮ দিন আগে সবাইকে বিদায় করেছি। কিন্তু সিলেটের ফারুক ও ইকবাল তখনও পিছু ছাড়েনি। দু’দিন পর সেই ইকবালকেও পিছু ছাড়া করেছি। সঙ্গে তখন শুধু একমাত্র ফারুক, ১৭ এপ্রিল দুপুরে উপলদিয়ার ফজলুদের বাড়িতে খেতে বসেছি। আমরা তখন সবাই মাটিতে পিঁড়িতে বসে খেতাম। ৬-৭ জনকে খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাত্ ফজলুর ছোট ভাই ১০-১২ বছরের রঞ্জু বলল, ‘মা, বজ্র ভাইর ছোট ভাই বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম।’ কথাটা শুনে কেমন যেন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। ‘বেল্লালকে তুই কোথায় দেখলি?’
— দেওপাড়ার কাছে।
— সত্যিই তুই দেখেছিস?
— হ্যাঁ, বেল্লালকে চিনব না?
— কথা বলেছিস?
— না, দুলাভাইয়ের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, তখন রাস্তা দিয়ে বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম। আমি আর সাহস করে এগিয়ে যাইনি।
বেল্লাল আমার থেকে চারজনের ছোট। তখন ওর আর বয়স কত— বারো-তেরো হবে। কান্নাকাটি আমাদের বাড়িতে নতুন কিছু নয়। একশ’জন মিলেমিশে কাঁদলেও আমার সমান হবে না। বাবার পিটুনি খেয়ে কেঁদেছি। বড় ভাইয়ের মার খেয়ে কেঁদেছি। মায়ের কাছে এটা-ওটা বায়না ধরে না পেয়ে কেঁদেছি। স্কুলে শিক্ষকদের বেত খেয়ে কেঁদেছি। ছেলেবেলায় আমার কাঁদার অন্ত ছিল না। কিন্তু তারপরও হঠাত্ করে ছোট ভাইয়ের কান্নার কথা শুনে বুক খান খান হয়ে গিয়েছিল। ভাত আর মুখে যাচ্ছিল না। কেমন যেন গলা শুকিয়ে আসছিল। তখনই ফজলুর মাকে বলে বিদায় নিয়েছিলাম। তিনি বিদায় দিতে চাননি তবুও নিয়েছিলাম। ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। চিরসঙ্গী ফারুক আর ফজলু ও রতনপুরের ফারুক এগিয়ে দিতে এসেছিল। ওদের বাড়ি থেকে প্রায় চার-পাঁচ মাইল পুবে নজরুলদের কাছতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এরপর দু’জন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সবচেয়ে দরিদ্র আত্মীয় ভোজদত্তের ফুপা মোকাদ্দেছ আলী খানের বাড়ী গিয়েছিলাম। আমাদের এই ফুপু গরিব হলেও আমাদের সবচেয়ে বেশি আদর-যত্ন করতেন। তার আদর ভালোবাসায় কোনো উজান-ভাটি দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই চরম দিনগুলোতেও না। এমনিতে তাদের দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা। কিন্তু তবু আমরা গেলে কী যে আদর-যত্ন করতেন। কোনো দিন মোরগ-মুরগি জবাই করে না খাইয়ে ছাড়তেন না। সেদিনও ছাড়েননি। বুঝতাম আমি তার ভাইয়ের ছেলে। তাই অত আদর। কিন্তু তখন যে প্রতিদিনই পাকিস্তান হানাদাররা আমার মাথার দাম লাখ টাকা ঘোষণা করে চলেছে। ধরে দিলেই লাখ টাকা পুরস্কার। আশ্রয় দিলে জীবননাশ। তারপরও তিনি ছাড়লেন না। ভাইপোকে খাওয়াতেই হবে। রাত ৯টার দিকে ছাড়া পেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটির দিকে রওনা হলাম।
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন