রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

অকার্যকর সংসদ ও ওয়ান-ইলেভেনের ভূত



বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এবারও বিরোধী দল ছাড়া সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হলো। এমন নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও গুরুত্বহীন সংসদ দুনিয়ায় আর কোথাও আছে কি-না আমরা কেউ জানি না। কেউ কেউ বলছেন, বিরোধী দলের সংসদে যাওয়া উচিত। দেশের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হলো সংসদ। কিন্তু বাস্তবে বর্তমান সংসদের মর্যাদা বা গুরুত্ব মোটেই তেমন নয়। সংসদের কোনো কথাই তেমন কেউ শোনে না, শোনার চেষ্টাও করে না। সবাই জানে কার কথা শুনতে হবে। তাই তারা তার কথাই শোনেন, আর কারও নয়। মনে হয়, এবারই অনেক বেশি সংসদ সদস্যকে কারাগারে রেখে অধিবেশন বসছে। আবার অদ্ভুতভাবে মাননীয় স্পিকার বলেছেন, ‘২০০ একর সংসদ ভবনের সীমার উপর তার কর্তৃত্ব।’ তাহলে মনে হয় তিনি সংসদ ভবনের স্পিকার! বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নন, বাংলাদেশেরও নন? একজন সংসদ সদস্য শুধু সংসদ ভবনের সীমানার জনপ্রতিনিধি নন, সারা দেশের। আর মাননীয় স্পিকারও শুধু রাবার স্ট্যাম্প নন, তিনি অভিভাবক। তার সদস্য যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের প্রতিও তার দায়দায়িত্ব আছে। ইচ্ছে করলেই এক্ষেত্রে নিজের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। মাননীয় স্পিকার বলেছেন, ‘জেলে আবদ্ধ সংসদ সদস্যদের সংসদে আসা না আসা বা আনা না আনার বিষয়ে তার কোনো দায়িত্ব নেই। ব্যাপারটা কোর্ট এবং সরকারের।’ এটা কোনো দায়িত্বশীল স্পিকারের কথা হলো না। কোনো সংসদ সদস্য তো সাজাপ্রাপ্ত নন? শুধু অভিযুক্ত। তারা যদি কেউ ইচ্ছে করেন সংসদে আসবেন, দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই তাদের ঠেকায়। বাংলাদেশের সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধিতে মাননীয় স্পিকারকে যে সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে তার অবশ্যই উচিত ছিল কারাবন্দি সব মাননীয় সদস্যকে চিঠি দিয়ে জানানো তারা সংসদ অধিবেশনে আসতে চান কি-না। যদি তারা সম্মতি দিতেন বা আগ্রহ প্রকাশ করতেন তাহলে তাদের অধিবেশনে আনা ছাড়া মাননীয় স্পিকারের কোনো গত্যন্তর ছিল না। আরও একটু দায়িত্বশীল সাহসী স্পিকার হলে ক্ষতি কী? ৭ম সংসদে স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সময় সংসদ চলাকালে কিশোরগঞ্জের মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামানকে এক ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেফতার করেছিলেন। তার স্ত্রীর পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় স্পিকার সংসদে রুলিং দিয়েছিলেন, একজন থার্ডক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের এ অপতত্পরতা গণতন্ত্র এবং সংসদকে অবমাননার শামিল। সেই ম্যাজিস্ট্রেটকে নোটিশ করে আনা হয়েছিল এবং মাননীয় স্পিকারের রুমে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করে সে যাত্রায় তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। এ-তো সংসদের রেকর্ডেই রয়েছে। সংসদ মর্যাদাশীল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হলে গণতন্ত্র মোটেই সুসংহত হবে না। তাই সংসদকে সংসদের মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো রাবার স্ট্যাম্প হলে চলবে না। এমনটা দেশবাসী কেউ চায়ও না।
ইদানীং কেন যেন সবাই বড় বেশি নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্রে এখন আর কেউ ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় আনে না। কি বললে বা করলে ক্ষণিকের লাভ হবে তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সার্বিক অর্থে সাধারণ মানুষ বড় অসহায়। তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। সাধারণ মানুষও যেন কেমন কাউকে ভরসা করা ভুলে গেছে। তারা কাউকে পাশে পেতে খুব একটা আগ্রহী নয়। সবাই দেখছে দেশ ভাল চলছে না। শুধু কষ্ট আর কষ্ট। কারও কোনো নিরাপত্তা নেই, মান-মর্যাদা নেই। তারপরও ‘রেল চলে ঝমাঝম—পা পিছলে আলুর দম’। সরকার বলছে খুব ভালো, বিরোধী দল বলছে খুব খারাপ। মানুষ দেখছে ভীষণ অসঙ্গতি। কম বেশি সব খানেই অশান্তি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। লক্ষ্য করার মতো তেমন অর্থনৈতিক সফলতা নেই। শেয়ারবাজার লুটপাট, ফটকাবাজ নানা কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণা করে মানুষকে দিনের পর দিন সর্বস্বান্ত করে চলেছে। ‘ডেসটিনি-২০০০’ বলে একটি সংস্থার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের ৩৪টির হিসাব জব্দ। রাজনৈতিক হানাহানি, কাটাকাটি তো লেগেই আছে। চর দখলের মতো সর্বত্র চলছে সবকিছু দখল। দুর্নীতিই যেন সুনীতি হিসেবে স্থান দখল করেছে। বিদেশি আগ্রাসন তো আছেই। ভূমিতে, আকাশে, বাতাসে সর্বত্র তার আলামত দেখা যাচ্ছে। আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক’দিন ধরে বলে চলেছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা এখনও সক্রিয়। তারা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।’ আলামত বেশি ভালো নয়। আমরা কেউ কেন যেন অনেক কিছুই তলিয়ে দেখছি না। দেশের রাজনীতি, সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক গতি ওয়ান-ইলেভেনের কর্মকাণ্ডে একশ’ বছর পিছিয়ে গেছে। সামাজিকভাবে বহু মানুষ অযথা লাঞ্ছিত হয়েছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এলে সাধারণত যেটা হয়, ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে যেমনটা করেছিলেন আরব সাগর থেকে দুর্নীতিবাজদের ফেলে দেয়া টনকে টন সোনা নাকি উদ্ধার করেছিলেন। কত মানুষকে যে ফাটকে ভরে ছিলেন তার কোনো হিসাব-নিকাশ ছিল না। ’৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল ইসকান্দার মির্জা সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করেন। ২০ দিন যেতে না যেতেই তাকে লন্ডনের এক হোটেল ম্যানেজারের চাকরি দিয়ে জেনারেল আয়ুব খান সব ক্ষমতা করায়ত্ত করেন। বছর না ঘুরতেই যাদের কারাবন্দি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন তাদের হাতে-পায়ে অনেক ফুলচন্দন মেখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারা করে ১০ বছর দুর্দান্ত প্রতাপে দেশ চালিয়ে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতাহারা হয়েছিলেন। ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আয়ুব খান ‘প্রভু নয় বন্ধু’ বইতে তার জামানার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। বইটির নাম ‘Friends Not Masters’। আমরা বিরোধীরা বাংলা করেছিলাম ‘বন্ধু নয় প্রভু’। সাধারণত এমনই হয়। বিরোধীদের কাজ বিরোধীরা করে, সরকারের কাজ সরকার করে। রাষ্ট্রব্যবস্থা যতকাল থাকবে ততকাল এ দ্বন্দ্ব থাকবে। এটা কোন দোষের নয়। এটাই বাস্তবতা। সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার এবং বিরোধী দলের প্রচার প্রোপাগাণ্ডা বিচারের মালিক জনগণ। কিন্তু আমার দেশের জনগণ ধীরে ধীরে সেই মালিকানাও হারিয়ে ফেলছে। আজ দেশের মানুষের যে দুরবস্থা এটা সত্যিকার অর্থে তুলে ধরার ক্ষমতা কেউ রাখে না। কারও কোনো স্বস্তি নেই, সুস্থিতি নেই। এক লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো অবস্থা। আপনি বেসরকারি কর্মচারী, বেতনের টাকায় ১৫ দিন চলবে না। আপনি ডাক্তার, ক্লিনিকে না বসলে বেতনের টাকায় বাসা ভাড়া দিতেই শেষ। খাওয়া-দাওয়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, কাপড়-চোপড়, চিকিত্সা—এসব কী দিয়ে চলবে? ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, সরকারি বা বেসরকারি? উপরি না নিলে বেতনের টাকায় গাড়ির তেল খরচও হবে না। একেবারে গ্রামের স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত অথবা যেকোনো কর্মচারী কর্মকর্তার নির্ধারিত বেতনে এখন আর মাস চলে না। নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে সত্ আয় আর ব্যয়ের কোনো সঙ্গতি নেই। দেশবাসীকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। তার ওপর দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশাসনে একেবারেই কেমন যেন একটা উদ্ভট অবস্থা। এই ২০-৩০ বছর আগেও অনেকেই তার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। সরকারি কাজকর্মকে পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করত। কিন্তু এখন আর সরকারি দায়িত্ব কারও কাছে কোনো পবিত্র কিছু নয়। আগে মানুষ ব্যক্তিগত আর সরকারি সম্পদের পার্থক্য করত। কিন্তু এখন যে যত ক্ষমতাবান সে সরকারি সম্পদ আর নিজের সম্পদের কোনো সীমারেখা টানে না। মনে করে সবই তার। ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একই রকম। তা না হলে আজ ক’দিন ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লাগাতার বলছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা ঘুমিয়ে নেই। তারা একইভাবে তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে।’ সরকারি অন্য মুখপাত্ররাও একই কথা বলছে। এটা তারা কাকে বলছেন? যারা বিরোধীদের নামে মামলা দিয়ে ১০-১১ দিনের মধ্যে সব প্রধান প্রধান নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পারেন তাদের? নাকি যারা ৩৯ দিনেও গুম হওয়া ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে পারেন না তাদের? অথবা যারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার হুমকি দিয়েছিলেন তাদের? অথচ ১০০ দিন পেরিয়ে গেল এখনও কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না। বাতাসে শোনা যায়, উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের সম্পৃক্ততাই নাকি ওই ব্যর্থতার কারণ। তাহলে তারা এই সময় ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের তত্পরতায় গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার অশুভ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কার উদ্দেশে এবং কেন? ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের অগণতান্ত্রিক তত্পরতা দেশবাসীর পছন্দ হয়নি বলেই তো মহাজোটকে অমন মহা বিজয়ী করেছিল। ক্ষমতায় বসে সাড়ে তিন বছরেও কেন ওইসব অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের হোতাদের আইনের হাতে সৌপর্দ করা হলো না? মহাজোটের অধিকাংশ নেতাই তো ওয়ান-ইলেভেনে নির্যাতিত। জনাব আবদুল জলিল, শেখ সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, মহীউদ্দীন খান আলমগীর—এরা তো কম নির্যাতিত হননি। আবদুল জলিল এবং মোহাম্মদ নাসিম তো মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। কই, তাদের অমন নির্যাতন অসম্মান যারা করেছিল তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা হলো? কেন হলো না? যেহেতু কোনো রকম ধরা-ছোঁয়া ছাড়াই খুব সহজে পার পেয়ে গেছে তাই তাদের সাহস কিছুটা বেড়ে গেলে দোষ দেবেন কাকে? বেঁচে থাকার জন্য কাজকর্ম তো করবেই, তাই তারা যদি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে তাহলে তাদের দোষ দেবেন কী করে? ওয়ান-ইলেভেনের সরকারপ্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ বাঙালি জাতির সব মান-সম্মান ধুলায় মিলিয়ে দিয়ে পৃথিবীময় বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। নাটের গুরু মইন উ আহমেদ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও কয়েক মাস সেনাপ্রধান ছিলেন। তার কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি। অবসর নেয়ার পরও ভদ্রলোককে কেউ কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তাহলে অমন না হয়ে উপায় কি? ওয়ান-ইলেভেনের এক ইফতারিতে সেনাপ্রধানের দাওয়াতে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলাম। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম হিসেবে আমিই ছিলাম। মেজর জেনারেল আবদুল মতিন এবং জেনারেল মইন উ আহমেদের মাঝে বসিয়ে ছিলেন। মাগরিবের নামাজ শেষে জেনারেল মইন উ আহমেদ খেদ ব্যক্ত করে আমাকে বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মিলিটারিদের নিয়ে এত কিছু তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম অস্ত্রধারণ করেছিল। সেই ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কী সব জঘন্য কথাবার্তা বলছে। এটা একটা ষড়যন্ত্র। একে সহজে মেনে নেয়া হবে না।’ আমিও বলেছিলাম, ‘২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় স্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র -শিক্ষকদের তো তার চাইতে হাজারগুণ প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। ছোট্ট একটি তুচ্ছ ঘটনায় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে তা কোনোমতেই ভাবীকালের ইতিহাস ভালো চোখে দেখবে না।’ বলেছিলাম, ‘ক্ষমতায় থাকলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে না। তাই অমন বলছেন। নিরাসক্তভাবে চিন্তা করলে দেখবেন ছাত্ররা আমাদের সন্তান। পিতা-মাতা হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের কী করা উচিত ছিল। কীভাবে তাদের বুকে আগলে রাখতে হয়।’ হঠাত্ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হলে হল থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রদের শাহবাগের আজিজ মার্কেটসহ অন্যান্য জায়গায় গরুর মতো জোড়ন দিয়ে কী নির্যাতনই না করা হয়েছে। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তারা গাড়িতে উঠতে পারেননি। যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই অত্যাচার করা হয়েছে। কোনো রাষ্ট্র তার সন্তানদের প্রতি অমন নির্মম আচরণ কখনও করে না। যখন যেখানে অমন আচরণ করা হয়েছে, সেখানেই রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। সে দিন রাষ্ট্রযন্ত্রের সেনাবাহিনীর সদস্যদের কী করা উচিত ছিল? উচিত ছিল হানাদার পাকিস্তানিদের মতো না করে আমাদের সন্তানদের নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করা, তাহলে জরুরি অবস্থার কুশীলবদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি পেত। কী প্রয়োজন ছিল অবৈধ উচ্ছেদের নামে একেবারে গ্রামপর্যায়ে শত শত বছরের পুরনো হাট-বাজার ভেঙে চুরমার করে দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে পথে বসানোর? প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই গরীব মানুষগুলো তো সরকারি কোনো কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলেনি। তবে কেন তারা অমন ক্ষতিগ্রস্ত হলো? জরুরি অবস্থা জারি করে যাদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো সেই প্রধান প্রধান অভিযুক্তরাই তো আজ রাষ্ট্র এবং সমাজের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ যিনি এনেছিলেন সেই আজম জে চৌধুরীকে তো একদিনের জন্যও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে যাকে গ্রেফতার করতে হন্যে হয়ে ঘুরছিল সেই ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিম এখন রাস্তাঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্যের সবকিছু তার করায়ত্ত। যে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রধান আহমেদ আকবর সোবহানকে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে আন্ডাবাচ্চাসহ গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছিল, না পেয়ে তার গুলশানের বাড়িঘরে কাঁটা দেয়া হয়েছিল— তিনিই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনকে দুই-আড়াইশ’ কোটি টাকা ভিক্ষে এবং খেলাধুলার জন্য দুটি মাঠের জমি ঘুষ নিয়ে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেছেন। মইন উ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে তার সঙ্গে বেশ বড় বড় ছবি তুলেছিলেন। এসবের কোনো কিছুরই তো প্রতিকার হয়নি। প্রতিকার হয়নি ওয়ান-ইলেভেনের প্রধান নায়ক জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর। ওয়ান-ইলেভেনেও যেমন ছিলেন এখনও তেমন আছেন। রাস্তাঘাটে শোনা যায়, বেগম খালেদা জিয়া বা জিয়াউর রহমানের ছেলে তারেক রহমানের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের পুরস্কার হিসেবেই তিনি নাকি এখনও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে আছেন। এমনকি চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরও হয়তো হবে। যদিও ব্রিগেডিয়ার বারী এবং মেজর জেনারেল আমীন আমেরিকায় লুকিয়ে লুকিয়ে হোটেলে কাজ করছেন। সর্বত্র এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে ওয়ান-ইলেভেনের কুশিলবরা তো সদর্পে থাকবেই। মানুষ তাদের অন্যায় কাজের বিচার প্রত্যাশা করেছিল মহাজোট সরকারের কাছে। তা তারা পায়নি। এ কারণে মানুষ মহাজোটের ওপর খুবই হতাশ।

শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

পিতাকে পুত্র

পিতাকে পুত্র


॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

তুমি নাই প্রায় এক সপ্তাহ। কেমন যেন একেবারে খাঁচায় বন্দী। ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে ছয়বার পালানো বাঁধনছাড়া মানুষ আমি। কিন্তু ওর আগে এক দিনও এভাবে কাটাইনি। ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে পালালে বাবা ও বড় ভাইয়ের ভয়ে সতর্ক থাকতে হতো। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পর পালিয়ে থাকা একেবারে অসহ্য। তাই বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছিল না। মাকে দেখার জন্য মন বড় ছটফট করছিল। তাই বেরিয়ে পড়ার মুহূর্তে; আজাদ-মুরাদকে নিয়ে মা এসেছিলেন। জীবনে কখনো মাকে দেখে অমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদিনি। মাও কেঁদেছিলেন। কিন্তু তার চোখে পানি ছিল না। কিছুণ পর শান্ত হলে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলেন, ‘বজ্র, আর ঘরে থাকিস না। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তোকে পেলে মেরে ফেলবে। ঘর থেকে নিয়ে তোকে মেরে ফেললে আমি শান্তিতে কাঁদতেও পারব না। তুই রাস্তায় গিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ করে যদি মারাও যাস তখন আমি প্রাণভরে কাঁদতে পারব। বলতে পারব আমার বজ্র বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করে জীবন দিয়েছে।’ হে পিতা, তোমাকে আজ কী বলি। আমার কোনো শ্রম, ঘাম কাজে এলো না। আমার মায়ের কষ্টের কোনো মূল্য হলো না। কেমন যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এখন নিমুরাদরা যা দাপাদাপি করছে তাতে সম্মানে বেঁচে থাকাই মুশকিল। গত ১৬ মে বোয়ালমারীতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি গণহত্যার স্মরণসভায় গিয়েছিলাম। সেই ঘটনাটা জানাতে বড় ইচ্ছে করছে তাই ওটা আগে বলে নিই। ১৫ মে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রাত যাপনের কথা তো বলেছি। পরদিন বোয়ালমারী যাওয়ার পথে রাজবাড়ী মোড়ে বিএনপির নেতা সাবেক মন্ত্রী কামাল ইবনে ইউসুফের এক ঘনিষ্ঠ কর্মী খন্দকার চান্দের বাড়িতে সকালের নাশতা করেছি। নাশতার চেয়ে তাদের 
আন্তরিকতা ও আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। কেন জানি না কোথাও গেলে লোকজন কম হয় না। আর খাওয়ার সময় তো এমনিতেই হিসাব থাকে না। আমরা ছিলাম ১২ জন। মনে হয় নাশতায় শরিক হয়েছিল তিন বারোং ছত্রিশ অথবা চার বারোং আটচল্লিশ জন। খন্দকার চান্দ বেশ হৃদয়বান মানুষ। যতœ করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রী নার্গিস খন্দকার মাচ্চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। খুব ধীরস্থির শান্ত স্বভাবের মানুষ। নাশতা শেষে একটা চমৎকার গামছা উপহার দিয়ে আমার হৃদয় জয় করে ফেলেছে। গামছার বদলে লাখো কোটি টাকা দিলেও হয়তো অতটা আনন্দিত হতাম না। সেখান থেকে ৯টা কয়েক মিনিটে বোয়ালমারীর পথে রওনা হয়েছিলাম। মাঝে বেশ কয়েক জায়গায় মোটরসাইকেল আরোহীরা অপোয় ছিল। তাই বোয়ালমারী পৌঁছতে বেলা ১১টা বেজে গিয়েছিল। এখন সভা সমিতিতে যেতে মোটরসাইকেল এক মস্তবড় উপদ্রব। তোমার সময় এটা মোটেই ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পুরো টাঙ্গাইল জেলায় মোট ১০-১২টা মোটরসাইকেল ছিল। ’৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি অস্ত্র জমা নেয়ার পথে তোমাকে নিয়ে যে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। যেখানে ৪০টা ভালো মোটরসাইকেল জোগাতে আমাদের ভীষণ পেরেশান হতে হয়েছিল। আজকাল বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক জেলায় চার হাজার মোটরসাইকেল জোগাড় করতেও তেমন বেগ পেতে হবে না।
যাক আগের কথা আগে বলে নিই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় রাস্তাঘাট ছিল খুবই অনুন্নত। আগে আরিচা-শ্রীরামদি ঘাট বা দৌলতদিয়া পারাপার হতে সময় লাগত দুই-আড়াই ঘণ্টা। অন্য দিকে নগরবাড়ী-আরিচায় যেতে তিন-চার ঘণ্টা লেগে যেত। ’৭২ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে প্রায় ১০০ সহযাত্রী নিয়ে কলকাতা সফর থেকে প্রথম ফরিদপুর সার্কিট হাউজে এসেছিলাম। খুবই পুরনো ফরিদপুর সার্কিট হাউজ। ১০০ বছরের বেশি হবে বয়স। ফরিদপুর সার্কিট হাউজের মতো হাতেগোনা আর মাত্র কয়েকটা। আশপাশের ঘরগুলোর উচ্চতা কম হলেও মাঝের দু’টি রুমের ছাদের উচ্চতা ২০ ফুট। গত বছর আজমীরে গিয়ে মারোয়ারা প্যালেসে ছিলাম। তারও ফোর থেকে ছাদের উচ্চতা ২০ ফুট। ৫০০ থেকে সাড়ে ৬০০ স্কয়ার ফুটের বিশাল রুম। ফরিদপুর সার্কিট হাউজের রুম কিছুটা ছোট ১৮ বাই ১৮। আগে ছিল ছয়-সাত একর ফাঁকা জায়গার মধ্যে সার্কিট হাউজ। এখন দালানকোঠা করে ভরে ফেলা হয়েছে। ’৭২ সালের পরে বেশ কয়েকবার ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রাত কাটিয়েছি। ’৭৩ বা ’৭৪ সালের ঘটনা। একদিন সার্কিট হাউজে গিয়ে দেখি রীবাহিনী ক্যাম্প করেছে। রীবাহিনী গঠনে কাদেরিয়া বাহিনীর বিশাল ভূমিকা ছিল। প্রায় ৯ থেকে সাড়ে ৯ হাজার কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ছিল রীবাহিনীতে। আমি গেছি শুনে রীবাহিনীর পরিচালক সরোয়ার মোল্লা খুব আগ্রহ নিয়ে ছুটে এলেন। অনেক গল্পগুজব হলো। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আর বলবেন না, বড় বিপদে আছি। শেষ পর্যন্ত জেল খাটতে হয় কিনা আল্লাহ মাবুদ জানেন।’ জেল খাটবেন কেন? ‘আর বলবেন না। শহীদ সাহেবের আর আমার সিকিউরিটি তর্কাতর্কি করে বক্সিং প্র্যাকটিস করতে গিয়ে একজন মারা গেছে।’ বললাম, ‘চিন্তা করবেন না। ভালোভাবে তদন্ত করুন, প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন।’ ঢাকায় এসে আনোয়ারুল আলম শহীদের কাছে সব শুনে খবর দিলাম মূল বীর কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ঘাটাইলের দুর্মুজ খাঁকে। পাঠক যারা ‘স্বাধীনতা ৭১’ পড়েছেন তারা অবশ্যই দুর্মুজ খাঁকে চিনতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তার কমান্ডার বেনু ব্যক্তিগত শত্র“ মেরেছিল। সে জন্য তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে নিহতের আত্মীয়স্বজন মা করে দেয়ায় সে বেঁচে যায়। তার স্থান হয় রীবাহিনীতে। সে সব সময়ই ভীষণ সাহসী আনমনা স্বভাবের ছিল। রীবাহিনী গঠনের সময় থেকেই সে আনোয়ারুল আলম শহীদের নিরাপত্তা রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। মহাপরিচালক, পরিচালক, লিডার, ডেপুটি লিডার ও অন্যান্য পদবির কর্মকর্তা নিয়ে রীবাহিনী গঠিত হয়। মহাপরিচালক ছিলেন কর্নেল নুরুজ্জামান। পরিচালক ছিলেন তিনজনÑ আনোয়ারুল আলম শহীদ, মোল্লা গোলাম সরোয়ার ও মেজর হাসান। কবে কোন সময় আনোয়ারুল আলম শহীদ আর মোল্লা গোলাম সরোয়ার দু’জন ফরিদপুর গিয়েছিল অথবা কোনোভাবে একত্র হয়েছিল। সেখানে দুই পরিচালকের দুই দেহরীর মধ্যে তর্কবিতর্ক বাধে। গোলাম সরোয়ারের রী দুর্মুজ খাঁকে বলে, ‘তোরা কোনো যুদ্ধই করিসনি, শুধু শুধু ফুটানি করিস।’ দুর্মুজ খাঁ রেগে গিয়ে জবাব দেয়, ‘আমরা যত যুদ্ধ করেছি তোরা তত যুদ্ধের নামও শুনিসনি।’ নানা তর্কবিতর্কের মাঝে হঠাৎ কী করে কথা হয় ঠিক আছে তুই আমারে এক বক্সিং দে, আমি তোরে আরেক বক্সিং দেই। দেখা যাক কার কত জোর। তবে একা নয়, দুই ডাইরেক্টরের সামনে দু’জন দু’জনকে বক্সিং দেবে। দিন-তারিখ ঠিক করে তারা সার্কিট হাউজের সামনে এক বিকেলে বক্সিং যুদ্ধ অনুষ্ঠিত করে। সেও এক অভাবনীয় ব্যাপার। দুর্মুজ খাঁ বলে, সরোয়ার মোল্লার সিকিউরিটিকে তুই আগে মার, সে বলে না তুই আগে মার। দুর্মুজ খাঁ গর্ব করে বলে আমি মারলে তুই আর মারার সুযোগ পাবি না। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় না। দু’জন অনেক তর্কবিতর্ক করে। পরিচালকেরা এতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। শেষ মুহূর্তে দুর্মুজ খাঁ গোলাম সরোয়ার মোল্লার দেহরীকে আঘাত করে। বুকের ওপর এমন জোরে ঘুষি মারে সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়, আর উঠতে পারে না। হাসপাতালে নিতে নিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এ নিয়ে তারা খুব ঝামেলায় পড়ে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারা মুক্তি পায়। সেখানকার আরেকটি ঘটনা। তখন দেশে খুব খাদ্য ঘাটতি চলছে। নানা দেশ থেকে আমদানি করা খাদ্য আমেরিকার কারসাজিতে আমাদের বন্দরে না ভিড়ে অন্যত্র ভিড়ছে। চিটাগাংয়ের কাছাকাছি আসা খাদ্য বোঝাই জাহাজগুলোকে অন্য বন্দরে পাঠিয়ে দিয়ে একটা অহেতুক খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছিল। যেখানে চালের দাম ছিল বারো আনা থেকে এক টাকা সের। সেই চালের দাম উঠেছিল আড়াই-তিন টাকায়। চার দিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তাই ’৭৪-এর শেষে দেশবাসীর কাছে আহ্বান করেছিলে, এক ইঞ্চিও জমি পতিত যাতে না থাকে। সরকারি জমি যে আবাদ করবে ফসল সে পাবে। আরিচা ফেরির কারণে মাঝে মধ্যেই ফরিদপুর সার্কিট হাউজে থাকতাম। ফরিদপুর সার্কিট হাউজে এক বুড়ো পিয়ন ছিলেন। সার্কিট হাউজের পিয়নেরা সাধারণত যেমন হন তেমন ছিলেন। সরকারি অতিথিশালায় বড় বড় যারা ওঠেন, তারা তেমন মাটির দিকে তাকিয়ে চলেন না। এটা প্রায় সর্বেেত্রই একই রকম। ‘নিজের ধন পরকে দিয়ে দৈবগ্য মরে কেথা বয়ে’ আমার অবস্থাও সেই রকম। অনেক কাজই সরল বিশ্বাসে করেছি। কোনো ভূতভবিষ্যৎ চিন্তা করিনি। ’৬২-’৬৫ পর্যন্ত বাড়ি থেকে ছয়বার পালিয়েছি। বাড়ি পালানোর সময়গুলো বড় অনাদর, বড় কষ্টে কেটেছে। তাই গরিব মানুষ দেখলেই মায়া হতো। এখনো যেমনটা হয়। সার্কিট হাউজের পিয়নের ছেলে নাকি লেখাপড়া করত। বইয়ের টাকা, এসএসসি পরীার টাকা, আইএ পরীার টাকা বছর তিনেকে পাঁচ-ছয় হাজার নিয়েছে। এখন পাঁচ-ছয় হাজার টাকার তেমন মূল্য নেই। কিন্তু ’৭২-’৭৫ সালে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ছিল অনেক টাকা। তখন সোনার দাম ছিল দেড়-দুই শ’ টাকা ভরি। ফরিদপুর শহরের আশপাশে এক পাখি জমির দাম হয়তো হতো হাজার টাকা, যা এখন হয়তো কোটি টাকা হবে। যাক ওগুলো। ওগুলো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য ফরিদপুর সার্কিট হাউজের পিয়নের সার্কিট হাউজ আঙিনায় ধান চাষ। ওই ধান লাগানোর জন্যও টাকা দিয়েছিলাম। মাঝে একবার দেখেছি ধানগাছ বেশ বড় বড় হয়েছে। তারও মাস দেড়েক পর কোনো এক সভায় কুষ্টিয়া অথবা চুয়াডাঙ্গা গিয়েছিলাম। ফেরার পথে রাতে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে উঠি। গাড়ি থেকে নামতেই সেই পিয়ন পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন। বাপের বয়সের মানুষ বড় বিব্রতবোধ করছিলাম। টেনে তুলে জিজ্ঞেস করতেই সন্তানহারা পিতার মতো কাঁদতে কাঁদতে আকুল হয়ে বলল, ‘আপনার টাকায় ধান বুনেছিলাম। সব ধান পেকেছে। একদিন ২৫-৩০ মণ কেটে বাড়িতেও নিয়েছি। এখন নাজির সাহেব বলছেন, আমি ধান নিতে পারব না। তিনি নিবেন। ধান মাড়ানো হলে সেখান থেকে অর্ধেক দেবেন। আমি এত কষ্ট করে ধান ফলালাম এখন নাজির সাহেব নিয়ে যাবে কোনো বিচার পাব না। আপনি একটা কিছু করেন।’ সে যে কী কান্না! না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। রাতেই নাজিরকে ডাকলাম। সব নাজিররা যেমন হয় তিনিও তেমন ছিলেন। একজন নাজির সারা জীবন একই জায়গায় থাকেন। চাকরিটা ছোট হলেও মতা অনেক। অনেক ডিসিই জানেন না তার জেলায় কোথায় কী আছে কী নেই। কিন্তু নাজিরের সব নখদর্পণে। ডিসিরা চাইলে নাজিররা পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। বলতে গেলে সিন্দুরে পোকার কলিজা অথবা বাতাসের ডগা এনে দিতে পারেন। নাজিরের চাকরি করতে হলে সবার আগে ‘জি হুজুর’, মানে পো ধরা শিখতে হয়। গরিব পিয়ন ধান বুনেছেন সেটা নিতে গেছেন কেন জিজ্ঞেস করলে বিনয়ের অবতার সেজে জবাব দিলেন ডিসি সাহেব বলেছেন, গরিব মানুষ ওর ধান তুলতে অসুবিধা হবে তাই সরকারিভাবে উঠিয়ে ওকে যেন অর্ধেক দিয়ে দেই। আমার এখানে কী করার আছে? সব ডিসি স্যারের হুকুম। পরদিন সকালেই চলে আসতে চেয়েছিলাম। বিষয়টা বোঝার জন্য একটু দেরি করে রওনা হব বলে ঠিক করলাম। ফোন করলাম ডিসি সাহেবকে। তিনি খুব অমায়িক ভদ্র মানুষ। বললেন, সকালে একসাথে নাশতা খান। যদি আমার বাড়িতে আসেন তাহলে খুব খুশি হব। জনাব মোহাম্মদ আলী ছিলেন তখন ফরিদপুরের ডিসি। ক’দিন পরই তিনি তোমার পিএস হয়েছিলেন। জনাব মোহাম্মদ আলীর আগে খুব সম্ভবত জনাব ফরাসউদ্দিন তোমার পিএস ছিলেন। লোক হিসেবে তিনি অসাধারণ। যেমন পণ্ডিত তেমনি ভালো মানুষ। এখনকার মতো হালকা নন। তখন যে পদে যার যতটুকু যোগ্যতা থাকা দরকার তার পুরোমাত্রাই ছিল। সকালে গোলাম মোহাম্মদ আলীর বাসায় নাশতা খেতে। মানুষটা দেখতে যেমন সুন্দর, ব্যবহারও ছিল অমায়িক। জিজ্ঞেস করলাম পিয়নের ধান নাজিরের নিয়ে যাওয়ার কথা। বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপারটা শুনেছি। নাজির বলছিলেন, গরিব পিয়নটা অর্থাভাবে ধান কাটতে পারছেন না। তাই নাজির সরকারিভাবে ধান কেটে যতটা সম্ভব দিতে চেয়েছেন। তুমি এখন বোঝ। ডিসি আর নাজিরের কথায় পার্থক্য কোথায়? ডিসি সাহেবকে বললাম, এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। সরকারি নীতিমালা অনুসারে সরকারি জায়গায় যে যা বুনবে সে ফসল সে ভোগ করবে। পিয়ন বুনেছেন পিয়নই ষোলো আনা পাবেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সার্কিট হাউজের জায়গাটি কার?’ বললেন, ‘পূর্ত মন্ত্রণালয়ের। ডিসি তার জিম্মাদার।’ বললাম, ‘পিয়নের ধান পিয়নকে নিতে বলতে পারেন কি না।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি বললে না করি কী করে। কিন্তু একবার বলে ফেলেছি। এখন অন্য রকম বললে সম্মান থাকে না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে, পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে যদি বলে।’ তিনি বললেন, ‘আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। আর আমিও চাই পিয়নের ধান পিয়ন নিক।’ ‘ঠিক আছে।’ মাগুরার সোহরাব হোসেন তখন ছিলেন ত্রাণ পুনর্বাসন ও পূর্তমন্ত্রী। ডিসির বাড়ি থেকে ফোন করলাম। পেয়েও গেলাম সহজে। পূর্তমন্ত্রী সোহরাব হোসেন দেখতে খুবই কালো। মাগুরার সোহরাব হোসেন আর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী দেখতে প্রায় একই রকম। গায়ের রঙ কালো হলেও মানুষ হিসেবে ছিলেন দিলখোলা। তাদের অন্তর ছিল ধবধবে সাদা। অমন পরিষ্কার হৃদয়ের মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর জাহাঙ্গীর স্মৃতি সেবাশ্রমের জন্য যখন যা চেয়েছি ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে দিয়েছেন। তালিকার কোনো জিনিস বাদ দেননি। এমনকি কখনো পরিমাণও কমাননি। কোনো একবার নাকি ডিজি রিলিফ কিছু কমিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীর লেখার ওপর কলম ধরব তা কী করে সম্ভব।’ কথাটা নিজে শুনিনি। ওটা আশপাশ থেকে শোনা। ’৭৩-এ সোহরাব হোসেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে নানা অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেসব অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে তুমি তিন সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলে। কমিটির নেতা ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী ফণী ভূষণ মজুমদার। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ভাই এবং আবদুর রাজ্জাক ভাই। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। হঠাৎ একদিন ডাক পেয়ে তার বাসায় যাই। তিনি সব কিছু খুলে বলেন, ‘ভাই, স্বাধীনতা যুদ্ধে সব কিছু হারিয়েছি। এখন দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিত্ব গেলে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ থাকে? কয়েকজন নেতা ষড়যন্ত্র করে আমাকে শেষ করতে চায়। ফণীদার বাড়িতে মিটিং হচ্ছে। কালকের মধ্যেই মন্ত্রিত্ব যাবে। তোমার যদি কিছু করার থাকে করতে পারো।’ সোহরাব ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফণীদার বাড়ি গিয়েছিলাম। কেউ কোনো বাধা দিলো না। আর তখন কেউ কোনো বাধা দিতও না। ফণীদার ঘরে গিয়ে দেখি মনি ভাই আর রাজ্জাক ভাই কথা বলছেন। ফণীদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কাদের, তুমি এ সময়?’ বললাম, ‘সোহরাব ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম তার নাকি মন্ত্রিত্ব যাচ্ছে।’ ফণীদা বললেন, ‘তাকে নিয়েই তো আলোচনা করছি।’ বললাম, ‘ভালো। দুর্নীতির অভিযোগে কাল সোহরাব ভাইয়ের মন্ত্রিত্ব গেলে পরশু দিন আরেকজনের যাবে, তারপর পুরো মন্ত্রিসভা নিয়েই টানাটানি হবে। সোহরাব ভাইয়ের গায়ের রঙ কালো হলেও ভেতরটা জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল আলোকিত। একটু চিন্তাভাবনা করবেন।’ মনি ভাই ও রাজ্জাক ভাই আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। মনি ভাই বললেন, ‘এই কাদের, তুই আবার এর মধ্যে জড়াতে গেলি কেন?’ বললাম, ‘জড়াতে যাইনি। সোহরাব ভাইয়ের সাথে বহু দিন ধরে জড়িয়েই আছি।’ রাজ্জাক ভাই উঠে এসে বললেন, ‘এই তুই কী করে সোহরাব ভাইয়ের প?ে’ বললাম, ‘আমি কোনো প-েবিপে না, সোহরাব ভাই ভালো মানুষ তাই বলতে এসেছিলাম।’ উঠে দাঁড়াতেই ফণীদা বললেন, ‘কাদের তুমি একটু নেতার কাছে যাও। এখানে যা বললে নেতাকেও তাই বলো গিয়ে। দেখো রাস্তা একটা বের হয়ে যাবে।’ আমার বাসার কাছেই গণভবনে তুমি থাকতে। সময়টা খেয়াল নেই। দেখেই বললে, ‘কী রে, কী মনে করে এসেছিস?’ বললাম, ‘সোহরাব ভাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার নাকি মন্ত্রিত্ব যায়। আমার চোখে সোহরাব ভাই খুবই ভালো মানুষ।’ তুমি বললে, ‘আরে ও দেখতে কালো হলে কী হবে ওর ভেতরটা বড় সাদা। কিছু মানুষ ওকে নিয়ে নানা কথা বলছে। তাই ফণীদাকে, মনি ও রাজ্জাককে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছি।’ বললাম, ‘মনি ভাই আর রাজ্জাক ভাই তো তার ঘোর বিরোধী।’ তুমি বলেছিলে, ‘আরে পাগল তা জানি।’ বলেছিলাম, ‘তা যদি জানো তদন্ত করতে দিলে কেন? কাল সোহরাব হোসেনের মন্ত্রিত্ব যাবে। পরশু আরেকজনের। তারপর তোমাকে ধরে টান দেবে।’ মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলে, ‘আরে থাম, বুঝেছি।’ সাথে সাথে ফণীদা, শেখ ফজলুল হক মনি ও রাজ্জাক ভাইকে ডেকে পাঠিয়েছিলে। বলেছিলে, ‘আর তদন্ত-ফদন্ত করতে হবে না। লিখে দাও কোনো অভিযোগের ভিত্তি নেই।’ সোহরাব হোসেন কাহিনী সেখানেই শেষ। সেই সোহরাব ভাইকে ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ আলীর বাড়ি থেকে ফোন করে অনেক কষ্টে পেয়েছিলাম। সোহরাব ভাইকে সব খুলে বললে তিনি ডিসি মোহাম্মদ আলীকে তুনি সব ধান পিয়নকে দিয়ে দিতে বললেন। তোমাকেও ফোন করেছিলাম, সব কথা শুনে মোহাম্মদ আলীকে বলেছিলে, ‘কাদের সীমার বাইরে কথা বলে না। ওর কথা রা করার চেষ্টা করো।’ ফরিদপুর সার্কিট হাউজের পিয়ন কাহিনী ওখানেই শেষ। নাজিরের বাড়িতে নেয়া সব ধান ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা ভারত-পাকিস্তান আমলে আর কখনো ঘটেনি। জেলার নাজিররাই সার্কিট হাউজের মালিক-মোক্তার। এনডিসি আর নাজির মিলে জেলা চালান। এনডিসি জুনিয়র অফিসার হন বলে অনেক েেত্র নাজিরদের এক দাঁতের বুদ্ধিও রাখেন না। নাজিররা খুব বুদ্ধিমান হন। তারা জানেন পানিতে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই তারা অমন করেনও না। ফরিদপুরের নাজিরও করেননি। এখন ফরিদপুর সার্কিট হাউজ আঙিনা নতুন নতুন নানা ইমারতে ভরে গেছে। ২৫-৩০টির বেশি রুম হবে। বিএনপির মন্ত্রী, জমিদার পরিবারের সন্তান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ নিশ্চয়ই সার্কিট হাউজ সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছেন। পুরনো ভবনটি ভেঙে না ফেলায় বেশ ভালো লেগেছে। আর বিশেষ করে দু-তিন বছর পর ফরিদপুর গিয়ে সেই পুরনো ভবনে সিট পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। (চলবে) 

রবিবার, ২০ মে, ২০১২

কেন এত অসহিষ্ণুতা?



ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম
প্রধান বিরোধী দল বা জোটের প্রথম সারির প্রায় সব নেতা ঠুনকো অজুহাতে এখন কারাগারে। যেমনটা পাকিস্তানের জমানায় আয়ুব খানের আমলে ঘটেছিল। শাসকের পীড়ন কোনোদিন জয়লাভ করেনি। এটা ইতিহাস। ইতিহাস খণ্ডনের ক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই। আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারি, কিন্তু ইতিহাস খণ্ডন করতে পারি না। গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে পরমত-সহিষ্ণুতা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষের মান-সম্মান, নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়া। প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বীই যদি না থাকে তাহলে রাজনীতি থাকে কোথায়? ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ায় কৃতিত্ব কোথায়? দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জয়ী হওয়ার আনন্দই আলাদা।
গণতান্ত্রিক সমাজ কারও একার নয়। সবার মতামত নিয়েই গণতন্ত্র। সভ্য সমাজে চরম শত্রুর সঙ্গেও ভদ্র আচরণ করতে হয়। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত অবস্থাতেও কোনো কারণে উভয় পক্ষের কথা বলার প্রয়োজন হলে তা ভদ্রতা ও শালীনতা বজায় রেখে করতে হয়। সব মিটিংই যে সফল হয়, তা নয়। কিন্তু আলোচনার কথা বলে একত্র হয়ে কেউ কাউকে হত্যা করে না। হ্যাঁ, নবাব আলীবর্দী খাঁ মারাঠা দস্যু বর্গি সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতকে আলোচনার্থে ডেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছিলেন। তাতে বাংলায় বর্গির হাঙ্গামা নির্মূল হয়েছিল। গ্রামবাংলার মায়েদের আর বলতে হয়নি, ‘শিশু ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?’ কিন্তু কেন যেন গণতন্ত্রের এ যুগে সব অগণতান্ত্রিক মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিরোধী দলের ৩৩ নেতাকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হলো। এখন যারা সরকারে আছেন আল্লাহ না করুন তারা যদি সরকারে না থাকেন, যারা বাইরে আছেন তারা যদি সরকারে যান, তাহলে যে ৬৬ জনকে খোঁয়াড়ে ঢোকানো হবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? এমন প্রতিহিংসা নিয়ে আর যাই হোক সুস্থ সমাজ চলে না। মানবতা থাকা চাই; সভ্যতা, শালীনতা থাকা চাই। ধীরে ধীরে রাজনীতির সম্মান ধ্বংস হয়েই গেছে। আজ রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। আজ রাজনীতি হয়েছে বিত্তের দাস। কিন্তু বিত্ত ছিল একদিন রাজনীতির দাস। এখন গোলাম মনিব হয়েছে, মনিব হয়েছে গোলামের চেয়েও অধম। তা না হলে ক’দিন আগে দেখলাম, এক বঙ্গসন্তানকে রাস্তায় ফেলে পুলিশ বুট দিয়ে তার গলা চেপে রেখেছে। তারও আগে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে যা-তা-ভাবে নাজেহাল করেছে। আবার ১৮ তারিখের এক পত্রিকার প্রথম পাতায় এক পুলিশ কর্মকর্তার দু’হাতে গলা চেপে ধরা দেখে হৃদয়-মন-অন্তরাত্মা শিউরে উঠেছে। এ কী করে সম্ভব? এ কী দেখছি? এ তো মাস্তানের কাজ, গুণ্ডা-জল্লাদের কাজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সুশৃঙ্খল বাহিনীর এ কাজ হয় কী করে? গুণ্ডা-তস্করের কাজ যদি সংবিধানের শপথ নেয়া কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তা করে, তাহলে দেশ থাকে কোথায়? বড় মর্মপীড়ায় ভুগছি আর অপেক্ষায় আছি—আমরা বাঙালিরা কবে শাড়ি-চুড়ি ভেঙে আবার মানুষ হব। এমন কাপুরুষোচিত আচরণ এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এই যদি গণতন্ত্র হয়, আমরা সে গণতন্ত্র চাই না। আমরা মানুষের মর্যাদা চাই। কেউ ১৬ কোটি জনতার গলা টিপে ধরুক, এটা বরদাশ্ত করা যায় না। আর যদি একজন পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী কিছু শক্তি আছে বলেই মালিকের গলা টিপে ধরতে পারে, তাহলে শক্তিমান বিশ্ব গোটা দেশটার যে এভাবে গলা টিপে ধরবে না, বা ধরে নেই, তাই বা বলি কী করে? তা না হলে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিতে পারছি না কেন? সব সময় কেমন যেন বুকের ওপর একটা পাথরচাপা ভার অনুভব করি। এটা আমার কথা নয়, এটা রাস্তাঘাটে, আকাশে বাতাসের কথা।
বঙ্গবন্ধু একসময় বলেছিলেন, ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।’ শক্তিমানরা অনেক সময় শক্তিহীনদের কথায় গা করে না। কিন্তু যখন শক্তিহীনদের সম্মিলিত আওয়াজ বিসুবিয়াসের আকার নেয়, তখন কারও পক্ষেই তা সামাল দেয়া সম্ভব হয় না। গণতান্ত্রিক আচার-আচরণকে নির্বাসন দিয়ে পরিচালনা করা যায় না গণতান্ত্রিক দেশ ও গণতান্ত্রিক সমাজ। কৌশল ভালো, কিন্তু বড় বেশি কৌশল অপকৌশলের নামান্তর। সরকারকে যেমন সারাদেশের সরকার, সবার সরকারের মতো আচরণ করতে হয়, ঠিক তেমনই বিরোধী দলকেও দেশের কল্যাণ চিন্তা করে অগ্রসর হতে হয়। যারা হয় না বা হতে পারে না তারা সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
গত ১৮ মে শুক্রবার বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গিয়েছিলাম। বড় ভালো লেগেছে তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সফলতা দেখে। অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী আমাদের ঘনিষ্ঠজন। তাঁর বাবা কফিল উদ্দিন চৌধুরী ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগের এমএনএ ছিলেন। তাই বদরুদ্দোজা চৌধুরীর আগেই তাকে চিনতাম। দু-চারবার রাজনৈতিক প্রোগ্রামে আর্থিক সাহায্যও নিয়েছি। বদরুদ্দোজা চৌধুরী ডাক্তারি পাস করে প্রথম যৌবনে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে চাকরি করতেন। মায়া আপা পড়তেন কুমুদিনী কলেজে। আমার শাশুড়ি নার্গিস হামিদ কোরায়শী ছিলেন কুমুদিনী কলেজের প্রিন্সিপাল। তাই তাদের বিয়েতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন, যে কারণে তারা আমার শাশুড়িকে শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের মতো দেখতেন। সে কারণে ওই পরিবারের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। অন্যদিকে বিকল্পধারার মূলস্তম্ভ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান একজন সফল ব্যবসায়ী হলেও তাকে আমি একজন বড় মাপের দেশপ্রেমিক হিসেবেই মনে করি। কতদিন তার কত অমূল্য সময় নষ্ট করেছি। কখনও কোনো উহ্আহ্ করেননি। বারবার চলে আসতে চাইলেও ছাড়তে চাননি। মনে হয়, আমার সঙ্গে সময় নষ্টই যেন তার বড় ব্যবসায়িক সাফল্য। বিএনপি সরকারের বস্ত্রমন্ত্রী থাকতে যেদিন প্রথম তার মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম, সেদিন সিরাজগঞ্জের ৫-৬ এমপির সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাকে দেখেই আলাদা ঘরে নিয়ে কথা বলেছিলেন। ছোট মানুষ, কাজও ছিল ছোট, সময় লাগেনি। কথা শেষে বেরিয়ে এলে এমপি সাহেবদের বলেছিলেন, ‘বাংলার বীর কাদের ভাই এসেছিলেন আমার কাছে। এ যে আমার কত গর্বের। দেশ ঠিকভাবে চললে, বঙ্গবন্ধু থাকলে কাদের ভাই মন্ত্রী থাকতেন, আমরা গর্ব করে তাকে দেখতে যেতাম। আজ আমি মন্ত্রী, তিনি এসেছেন। আপনাদের রেখে তার সঙ্গে কথা না বললে এটা হতো আমার জাতির সঙ্গে চরম বেয়াদবি। এ দুনিয়ায় আমরা যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ একজনের কাজে আরেকজনকে লাগতে হবে। বেহেশত-দোজখে আমাদের যেহেতু কিছুই করার থাকবে না, তাই আমরা কারও কোনো কাজে আসব না।’ তার সেদিনের সে কথা আজও আমাকে আলোড়িত করে। মাঝে মাঝে তার কাছে গেলেই আমার দলকে দু-চার লাখ টাকাপয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেন। যেখানে লাগবে কোটি, সেখানে অনেকেই দেন লাখ—এটাই স্বাভাবিক। তবে এক বিশাল হৃদয়ের অসাধারণ মানুষ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। তাই তার বারবার আহ্বান ফেলতে পারিনি, সাড়া দিয়েছিলাম। বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে, এক নতুন চিন্তার খোরাক দিয়েছে। বিএনপি সরকারে থাকতে তাদের ব্যর্থতা, অদক্ষতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে যেমন বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর জন্ম, তেমনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী সরকারের অনেক কাজের সঙ্গে একমত হতে না পেরে আমরা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেছিলাম। উভয় দল এক রকম অত্যাচারিত হয়েছে। যে মূল দল থেকে বিভক্ত হয়ে বিকল্পধারার জন্ম, সেই দল বিএনপির জাতীয় নেতারা অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উপস্থিত হয়ে তাদের জন্মের বাস্তবতা স্বীকার করে অভিনন্দন জানানোয় আমি ভীষণ আনন্দিত হয়েছি। একেই বলে রাজনীতি। রাজনীতিতে যে শেষ কথা নেই, এটাই হলো তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাই আমরা আশা করে রইলাম কবে হবে সেই শুভদিন যেদিন আওয়ামী লীগকেও স্বীকার করতে হবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্ম ছিল সময়ের এক অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা। অন্যদিকে কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম বীর প্রতীক অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সব সময় চমত্কার বক্তৃতা করেন। খোলামেলা হৃদয় দিয়ে বলেন। এখনও বড়সড় শক্তিশালী রাজনৈতিক হুমকি না হওয়ায় তাদের ওয়ান-ইলেভেনের সময় জন্ম প্রসঙ্গে কেউ তেমন সমালোচনা করে না। কারণ মাঝারি গাছ নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই। বড় হলে ঝড়ে ভাঙে, ছোট হলে ছাগলে খায়। ভদ্রলোক আমাকে অসম্ভব সম্মান করেন, যে কারণে আমিও তাকে ভালোবাসি। আর সব থেকে বড় কথা মুক্তিযুদ্ধে তার যথার্থই ভূমিকা রয়েছে। তিনি যখন বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এককভাবে তেমন ভূমিকা রাখতে পারা যাবে না মনে করেই বিএনপির জোটে গেছেন। কেন যেন তখন আমার মনে হয়েছিল, তার যখন মনে হলো একা থেকে তেমন কিছু করা যাবে না বলে জোটবদ্ধ হওয়া দরকার, তখন সরকারেরও কি মনে হয়েছে জোটবদ্ধ সব দলের প্রধান নেতাকে অহেতুক গ্রেফতার করলেও তাকে বাইরে রাখা দরকার? সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হয়েছে, ৮ বছর আগে যে সময় বিএনপির চরম সুদিন, তখন কী কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব তার তিল তিল শ্রমে-ঘামে গড়ে তোলা সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর জন্ম দিয়েছিলেন। একেই বোধ হয় বলে জগত্, একেই বলে যাওয়া-আসা। এটাই বাস্তবতা।
বিকল্পধারার আরেক সম্ভাবনাময় নেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একমাত্র ছেলে মাহী বি চৌধুরী টোনাকে নিয়ে অনেকেই স্বপ্ন দেখেন। আমার স্ত্রী তাকে কোলে নিয়েছে। ও খুব ছোট থাকতে বহুবার টাঙ্গাইলে গেছে। আমরা তাকে খুবই স্নেহ করি। মনপ্রাণ উজার করে চাই—সে সফল হোক, জাতিকে অমানিশার অন্ধকার থেকে বের করে আনার নেতৃত্ব দিক। তাই আমার বক্তৃতার একাংশে বলেছিলাম, মাহী বি চৌধুরী বর্তমান যুবসমাজের সম্ভাবনাময় নেতা। এক হাতে দুই মাছ ধরা যায় না। দেশ ও দেশবাসীর অঙ্গের ভূষণ যদি হতে চাও, তাহলে সব ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা থাকতে হবে মানুষের ওপর। সার্বক্ষণিক রাজনীতিক হতে হবে। খণ্ডকালীন রাজনীতি করে উপনেতা পাতিনেতা হওয়া যায়, জাতির নেতা হওয়া যায় না। মাহী আমার সঙ্গে একমত হয়নি। না হওয়ারই কথা। কারণ চিন্তা-চেতনার দিক থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল চিন্তায় আমাদের পার্থক্য অনেক। তবুও তাকে বলে এসেছি, এটা-ওটা করে এ পর্যন্ত কেউ জাতীয় নেতা হয়নি, জাতীয় নেতাদের অনুসারী হয়েছে। জানি না আমার কথা ওর চিন্তায় নাড়া দেবে কিনা, কিন্তু আমি তার সফলতা কামনা করি। সর্বোপরি সভ্য দেশ ও সমাজ হিসেবে আমি সুশাসন চাই, গণতান্ত্রিক শাসন চাই। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সুস্থ রাজনৈতিক দল বিকাশ অন্যতম উপাদান। রাজনৈতিক দল যত সবল ও সফল হবে, দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চা তত নিরাপদ হবে। ছোট্ট চারাগাছকে যেমন সময়মত সার-পানি দিয়ে বড় করতে হয়, তেমনই রাজনীতিকে সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী করতে হলে রাজনৈতিক দলকে সঠিকভাবে রাষ্ট্র এবং সমাজের লালনপালন করতে হয়। তাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বারবার বাধা দিয়ে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা সমাজ বিকাশ হয় না।
গত পর্বে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিময় ধানগড়া নিয়ে আলোকপাত করেছিলাম। অনেক পাঠক তার পরের কথা জানতে চেয়েছেন। তাই ওদিকটায় কাউকে অন্ধকারে রাখতে চাই না। গভীর রাতে যখন ছাতিহাটির পৈতৃক ভিটায় পৌঁছই, তখন বাড়ির চেহারা দেখে অবাক হয়ে যাই। অনেক ডাকাডাকির পর চাচা বেরিয়ে আসেন। বেরিয়েই তিনি বলেন, ‘ভাই-ভাবীরা তো এখানে নেই।’
—কেন? তারা কোথায় গেছেন?
—কয়েকদিন হলো তারা ধানগড়া চলে গেছেন। মা-বাবা, ভাই-বোনদের দেখতে মন বড় ছটফট করছিল। তাই আর কোনো প্রশ্ন না করে ধানগড়ার দিকে পা বাড়াই। ঘুটঘুটে অন্ধকার, চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক, আর মিটমিটে জোনাকির আলো। ওর আগে কোনোদিন ধানগড়া যাইনি। কিন্তু বাবা-মা যেখানে ছিলেন, সে বাড়ি খুঁজে পেতে কোনো কষ্ট হয়নি। গ্রামের প্রান্তঃসীমায় লোকজনের সঙ্গে দেখা হওয়ায় তারাই নিয়ে গিয়েছিল নাজির হোসেন নাদুর বাড়ি। রাত সাড়ে ১২টা-১টা হবে। আস্তে করে ‘মা, মা’ ডাক দিতেই দরজা খুলে গেল। মনে হয়, মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য সব সময় হৃদয়ের দুয়ার খুলেই রাখেন। প্রায় ২০ দিন পর মা-বাবাকে পেয়ে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। খুব একটা সময় লাগেনি, সব ভাই-বোন ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বানরের বাচ্চার মতো চারদিক থেকে জড়িয়ে ধরেছিল। ছোটবেলায় ভাই-বোনেরা আমাকে বড় বেশি জড়াজড়ি করে থাকত। কেন যেন আমি ছিলাম ওদের বড় কাছের মানুষ। মনে হয়, মা সব সময় আমার জন্য খাবার রেখে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের অত কঠিন সময়েও সব বাচ্চাকাচ্চাদের বাবা-মা আগলে ছিলেন। একমাত্র বড় ছেলে লতিফ সিদ্দিকী এমপি আর আমি তাদের পাখনার বাইরে। দশ মিনিটও লাগেনি আমাদের খাবার দিতে। আমরা গেলে নাজির হোসেনের বাড়ির সবাই জেগে উঠেছিল। এই সেদিন নাজির হোসেনের স্ত্রী বেগম হাফছা খাতুন যে মারা গেলেন, তিনি সবার আগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন। খাবার খেয়ে মা-বাবার পাশেই শুয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে দেখলাম ধানগড়া গ্রাম। বংশাই নদীর পাড়ে হতদরিদ্র ছোট্ট একটি তন্তুবায়ী পল্লী। তারা সবাই কারিগর। কাপড় বুনে রুটি-রুজি নির্বাহ করে। কোনো রাস্তাঘাট নেই। গ্রামের মানুষ খুব একটা বাইরে যায় না, বাইরের মানুষও তেমন আসে না। একেবারে নিরিবিলি কোলাহলহীন ছোট্ট একটি গ্রাম। সকালে নাস্তা খেয়ে মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা এখানে কেন? কীভাবে এলে?’ তখনই শুনলাম পৃথিবীর এক নির্মম দুর্ভাগ্যের কাহিনী।

শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

পিতাকে পুত্র

পিতাকে পুত্র


॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আজ ১৯ মে। দিনগুলো খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। পুরো মাসটাই বড় অশান্তিতে চলেছে। ক’দিন ধরে সরকারি দল বলছিল, দুই মামলাতেই কাতÑ ’৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর নামে আগরতলা মামলা দিয়ে আইয়ুব খানের চেলারা যেমনটা বলেছিল। ১৬ মে বিরোধী দলের সব নেতাকে কারাগারে ঢুকিয়েছে। সরকারি দলের সে কী উল্লাস! এবার কেল্লা ফতে। মনে হয় সরকার বা সরকারি দল ইচ্ছে করেই হরতালের রাস্তায় যাচ্ছে। তাদের ধারণা বিরোধী দলকে বারবার হরতাল দিতে বাধ্য করতে পারলে মানুষ তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। সরকারের যে এখানেও কিছু দায়িত্ব আছে এ নিয়ে তারা গা করছেন না। একবারো ভাবছেন না এক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান শেষ হয়েছে। তাই ইদানীংয়ের দুই মামলার কী পরিণতি হবে তা আল্লাহই জানেন। এসব বোঝাই কাকে? সবাই বড় বেশি বোঝে। লোকজন বলাবলি করছে, সুরঞ্জিৎ সেনের ঘুষ কেলেঙ্কারি ঢাকা দিতে ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। সারা দেশ সে জন্য খুবই উদ্বিগ্ন। ঘটনাটি ব্যক্তি, পরিবার কিংবা দেশীয় সীমানায় আবদ্ধ নেই। একেবারে আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে বলা হয়েছে। এমনকি ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর কান্না আকাশে-বাতাসে ভাসছে। তার সাত-আট বছরের ছোট্ট মেয়ের হিলারি কিনটনকে কাঁচা হাতে লেখা চিঠি কত ল কোটি মানুষের মনে দাগ কেটেছে। বাবা ছাড়া তার ছোট্ট ভুবন অন্ধকার। তার ঘুম আসে না। কে তার ছোট্ট ভুবন ভরিয়ে দেবে, নির্বিঘেœ ঘুমের গ্যারান্টি দেবে?
আজ অন্যের কথা ভাবার কেউ নেই। কেমন যেন নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত। রাষ্ট্র, সমাজ, সমাজপতিরা কেউ কারো কথা ভাবে না। আগে রাস্তাঘাটে কেউ আহত হলে তাকে সাহায্য করতে ভিড় জমে যেত। সে যেই হোক, কোনো রক্তাক্ত মানুষ কখনো রাস্তায় পড়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যেত না। এখন দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্ঘটনাই বেশি, ঘটনা কম। গত ১৬ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারীর হাসামদিয়া গিয়েছিলাম তোমার প্রিয় শাহ আবু জাফরের বাড়ি। তাকে খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী হাসামদিয়ার ৩৩ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে এবং পুড়িয়ে মেরেছিল, গিয়েছিলাম তাদের স্মরণসভায়। এখন রাস্তাঘাটে সে যে কী ঝকমারি তা বলার মতো নয়। যত রকমের সুব্যবস্থাই থাকুক না কেন, নিরাপদে রাস্তাঘাটে চলার উপায় নেই। মনে হয় দুই-আড়াই বছর যশোরের দিকে যাওয়া হয়নি। তাই আরিচা-নগরবাড়ী, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। যদিও এখন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। মাদারীপুরের শাজাহান খানের বাবা আসমত আলী খান তোমার এমপি ছিলেন। কিন্তু শাজাহান খান জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। অনেক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে গুম এবং হত্যা করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি এখন তোমার কন্যার নৌপরিবহনমন্ত্রী। আদতে পরিবহন শ্রমিক নেতা। এক দিকে যেমন কোনো কিছু ছাড়াই গাড়িঘোড়ার ড্রাইভারদের লাইসেন্স দিতে বলেন, অন্য দিকে অতি সম্প্রতি বরিশালে তার গাড়ির সাথে এক বাসের সংঘর্ষ হওয়ায় বাসচালককে ফাঁসি দিতে চেয়েছেন। গাড়ি দিয়ে অন্যকে হত্যা করলে, তার গায়ে-পায়ে লাগে না। নিজের গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ায় তিনি চালকের ফাঁসি চান, এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! কারো কোনো সহনশীলতা নেই। গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হলে চালকের ফাঁসি হবে কেন? আইনানুগ যতটুকু শাস্তি হওয়ার ততটুকুই হবে। আসলে আমাদের সড়কব্যবস্থা নিরাপদ নয়। যারা গাড়ি চালান তারা যে সবাই খারাপ তেমনও নয়। গাড়ি চালানোর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে কাউকে প্রশিণ দেয়া হয় না। গাড়ি চালাতে গিয়ে যে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে হয় তা বলার কেউ নেই। একজন চালকের হাতে যে কতগুলো মানুষের জীবন সেই বুঝটুকুও তাকে দেয়া হয় না। সামান্য একটু প্রশিণ দিলেই যেখানে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে, কিন্তু কেউ আন্তরিক নয়। সবই চলছে গদাই লস্করী চালে।
একবার ভেবেছিলাম ১৬ মে সকালে রওনা হয়ে সরাসরি বোয়ালমারীর অনুষ্ঠানে অংশ নেবো। আবার মনে হলোÑ না, ১৫ তারিখ রাতে ফরিদপুর গিয়ে থাকি। সেখান থেকে পরদিন খুব সহজেই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া যাবে। সেই হিসেবে ডিসি, এসপি ফরিদপুরকে চিঠি দিয়েছিলাম। তাই ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিলাম। রাস্তা বেশ ফাঁকাই ছিল। কিন্তু গাড়িতে গ্যাস ছিল না। সাভারের পর সাড়ে সাতটার দিকে এক সিএনজি স্টেশনে গিয়েছিলাম। স্টেশনের গার্ড প্রথম প্রথম খুব তারস্বরে বলল, ‘৯টার আগে কোনোক্রমেই গ্যাস দেয়া যাবে না।’ সহকর্মীরা গিয়ে স্টেশনের এক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ডেকে আনল। তাকে বললাম, ‘আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমরা ফরিদপুর যাচ্ছি। একটু গ্যাস হলে ভালো হয়।’ ভীষণ আন্তরিকতার সাথে তিনি আমাদের গ্যাস দিলেন। দু’গাড়িতে মাত্র ছয়-সাত শ’ টাকা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফিলিং স্টেশনটি কার?’ বললেন, ‘নাভানা গ্র“পের শফিউল ইসলাম কামালের।’ তিনি আমাদের বহু বছরের পরিচিত। একসময়ের বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ধনী জহুরুল ইসলাম বেঁচে থাকতে কত সময় কতভাবে সাহায্য করেছেন। প্রায় ৫০ বছর তারা আমাদের আত্মীয়ের মতো। এখন আগের মতো যোগাযোগ না থাকলেও সম্পর্ক ভালোই আছে। ফেরিতে আগেই বলে দেয়া ছিল। একে তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আমার এক সহকর্মী উল্লাপাড়া কলেজের ’৬৯-৭০ সালের ভিপি জলিল কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছিল জানি না। কিভাবে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের দৃষ্টি কেড়েছিল তাও জানি না। লেখাপড়া জানা তখনকার ভালো ছেলে এখন ভালো মানুষ বিআইডব্লিউটিসির সচিব। নানা সময় উত্থান-পতনের কথা ভাবে না, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মতোই ভাবে। সেই জলিলকে বলেছিলাম। তা ছাড়া সেই ’৯০ থেকে ফেরি পারাপারে অর্জুনের সারথী ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মতো আমাদের সারথী বিআইডব্লিউটিএ’র শ্রমিক নেতা নারায়ণগঞ্জের শুকুর মামুদ। মনে হয়, কয়েক বছর যাবৎ সরকারিভাবে অবসরে গেছে কিন্তু কর্মজীবনে তার অবসর নেই। তাকেও বলেছিলাম। তাই ফেরি পারাপারে ছিল এক রাজকীয় ব্যবস্থা। যাওয়ার পথে তরা সেতুতে এক মজার ঘটনা ঘটে। গত বিশ বছর তরা সেতুতে আমার কাছ থেকে কেন যেন পয়সা-কড়ি নেন না। কেন নেয় না তা বুঝি না। কিন্তু টোল কালেক্টর যারাই থাকেন ছোট-বড় যেই হোন কেউ পয়সা নেন না। তখন ছিল রাত আটটার মতো। খুব একটা ঝকঝকে আলোও ছিল না। হাত বাড়ালে পেছনের সিট থেকে পয়সা দিয়ে গাড়ি টান দিতেই টোল কালেক্টর চিনতে পেরে আচমকা বলে উঠলো, ‘ইস্! পয়সা নেয়াটা ভালো হলো না।’ আমরা ততণে চলে এসেছিলাম। পরদিন ফেরার পথে কোনো মতেই পয়সা দিতে পারিনি। তারা কিছুতেই পয়সা নেবেন না। আমি নাকি তাদের কাছে খুব সম্মানী। ফেরার পথে পয়সা না নেয়া চার-পাঁচজনের কলরব হৃদয়ে নাড়া না জাগালেও আগের দিনের ‘ইস্! পয়সা নেয়াটা ভালো হলো না’ আমাকে নাড়া দিয়েছিল।
দৌলতদিয়ার পাড়ে নেমে সে যে কী প্রচণ্ড ভিড়। কল্পনা করা যায় না। তবুও বেশ সহজেই বেরিয়ে এসেছিলাম। ঘাটপাড়ের কিছু লোকজন রাস্তা করে দিয়েছিলেন। রাত ১০টা ১০ মিনিটে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে পৌঁছে দেখি সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের ঘনিষ্ঠ কর্মী খন্দকার চান এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুস সালাম লাল বেশ কয়েকজনকে নিয়ে অপো করছে। এখন আর ফরিদপুর সার্কিট হাউজ আগের মতো নেই। নতুন নতুন বিল্ডিং তুলে সে যে কী অবস্থা করেছে ভাবাই যায় না। তোমার তো মনে থাকার কথা, ’৭৪-৭৫ এ তুমি যখন দেশের এক ইঞ্চিও মাটি পতিত না রাখতে আহ্বান জানিয়েছিলে, তখন এই সার্কিট হাউজের এক বয়সী পিওন ১৮০ মণ ধান উৎপাদন করেছিলেন সার্কিট হাউজের পতিত জমি আবাদ করে। ঘটনাটি পরের পর্বে তোমাকে মনে করিয়ে দেবো। সে যাই বলি আগের চেয়ে বিছানাপত্র, ফ্যান, এসি, টিভি সে এক এলাহি কারবার। রাতে খাবার খাইয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম লাল। রাতেই মেয়ে, ছেলের বউ, নাতি-নাতকুর নিয়ে এসেছিল। বাচ্চাগুলো বড় গোলমেলে। চেনে না জানে না, ‘দাদু দাদু’ বলে তোলপাড় করে ফেলেছিল। বাচ্চাদের বাচ্চার মতো করা ভীষণ ভালো লেগেছে। সকালে বিজনকুমার সাহা নামে ফরিদপুরের এক নিরীহ কর্মী এসেছিল। মনে আছে কি না কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তোমারও তাকে চেনার কথা। স্বাধীনতার পর ওকে বেশ কয়েকবার তোমার কাছে নিয়ে গেছি। ষাটের দশকে ওরা আমাদের পাড়ায় বাস করত। ওর দাদা নির্মলকুমার সাহা ছিলেন টাঙ্গাইলের জুট ইন্সপেক্টর। সেই সুবাদে ওদের সাথে আমার পরিচয়। বিজনকুমার সাহা সব সময় আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছিল। মুক্তিযুদ্ধে আমার সাথে থাকতে পারেনি বলে ওর ভীষণ দুঃখ ছিল। তাই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তুমি নিহত হলে আমি যখন এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করি তখন সে কত জায়গা ঘুরেফিরে আমাদের চান্দভুই ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হয়েছিল। মোরারজী দেশাই ও জিয়া সরকারের চুক্তি অনুযায়ী পুশব্যাক করা প্রতিরোধ সংগ্রামীদের মধ্যেও সে ছিল। হালুয়াঘাট, নরুন্দী, ময়মনসিংহ, লৌহজংয়ের কলাকোপা নির্যাতন ক্যাম্পসহ নানা কারাগারে কাটিয়ে একসময় মুক্তি পায়। ’৮১-তে তোমার কন্যা দিল্লি থেকে ঢাকা এলে তাকে দেখাশোনার জন্য হালুয়াঘাটের সালাম, আয়নাল, মানু, রেন্টু, সেন্টু, দুলাল ও এই বিজনকুমার সাহাকে দেয়া হয়। বিজনের গ্রামের বাড়ি মুকসুদপুর। গোপালগঞ্জ শহরেও ওদের বাড়ি আছে। দারুণ নিষ্ঠার সাথে প্রায় বারো বছর জননেত্রীকে এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি আগলে রাখে। কী দুর্ভাগ্য জানো, সেই বিজনকুমার সাহাকে তোমার কন্যা এখন চেনে না। আরো দুর্ভাগ্য গোপালগঞ্জ শহরে ওদের বাড়ির উঠানের ৯ ডেসিমাল জায়গা এনিমি বলে আওয়ামী লীগের পাণ্ডারা দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। কতজনের কাছে ছোটাছুটি করেছে কিন্তু কোনো প্রতিকার পায়নি। আমি নিজেও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা যিনি দেখাশোনা করেন সেই আলহাজ শেখ আবদল্ল­াহকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলাম কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আবদুল্লাহরা যখন মতাবান ছিল না তখন বড় ভালো ছিল। দ্বিতীয়বার আমি যখন তোমার কবরে যাই তখন শেখ আবদুল্লাহ কী যে যতœ করে তার বাড়িতে খাইয়েছিল, তার স্ত্রীর সে যে কী অসাধারণ রান্না, প্রায় আমার মায়ের মতো। মনে হয় তারা এখন হাওয়ায় আছে। কারো সুবিধা-অসুবিধা হৃদয় দিয়ে বিচার করে না। ফরিদপুর সার্কিট হাউজে বিজনকুমার সাহার মলিন মুখ দেখে বড় অশান্তি লেগেছে। বলে এসেছি, ধৈর্য ধরো অবশ্যই সব ঠিক হয়ে যাবে। বাকি কথা তোমাকে পরের পর্বে বলব। বোয়ালমারী শাহ জাফর টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের চমৎকার মাঠে তাপদাহের অনুষ্ঠানে অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে। এএইচ গ্র“পের আবুল হোসেন এবং তার স্ত্রী সুরভী হোসেন চামেলীর স্মরণসভায় বক্তৃতা আমার খুবই ভালো লেগেছে। এসব পরে বলছি। আগে আগের কথা বলে নিই।
তোমার মৃত্যুর পর কেন যে বলেছিলাম, ‘ বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র কামাল, জামাল, রাসেলকে খুনিরা হত্যা করতে পারলেও আমি কাদের সিদ্দিকী তার চতুর্থ পুত্র। পিতৃহত্যার বদলা আমি নেবোই নেবো।’ তার পরও চার-পাঁচ দিন ঢাকাতে ছিলাম। বড় খারাপ ছিল সেই দিনগুলো। প্রথম রাত জহুরী মহল্লায় মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান কুতুবের বোনের সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে। জায়গাটা খুব একটা নিরাপদ মনে হয়নি। তাই পরদিন দাদু মোহাম্মদ মোদাব্বেরের গজনবী রোডের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কথা ছিল তার পাশে ডলদের বাড়িতে কখনো গিয়ে উঠব। ডলের বাবা-মা সারা রাত জেগে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি। তাদের সে রাতের কষ্টের কথা মনে হলে আজো বড় কষ্ট হয়। আবার আনন্দও পাই এই ভেবে যে, কত আপনজন তুমি মরে যাওয়ার পর ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু ছোট বোনের বান্ধবীর বাবা-মা ওরকম দুঃসময় চরম বিপদের কথা জেনেও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিতে সারা রাত জেগেছিলেন। পরদিন গিয়েছিলাম ধানমন্ডির নিপ্পুদের বাড়ি। নিপ্পু টাঙ্গাইলের খোদাবক্স মোক্তারের মেয়ে। খোদাবক্স মোক্তার ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। তার মেয়ের জামাই বানিয়ারার কে জেড ইসলাম খোকন আমাদের আত্মীয়। ১৯৭৩ সালে জরুরি অবস্থার সময় মজুদবিরোধী আইনে তহবিল তসরুপের মামলায় একতরফা জেল হয়েছিল। আইনটি ছিল একেবারে জংলি। অনেকটা মানবতাবিরোধীও বলা চলে। সাীসাবুদ, আত্মপ সমর্থনের সুযোগ ছিল না। সেই সময় খোকন কিছু দিন আমার বাড়িতে পালিয়ে ছিল। তখন প্রশাসনে আমাদের যথেষ্ট সম্মান ও প্রভাব ছিল। তুমি ছিলে বলেই তা যে ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তুমি মারা যাওয়ার আগেই সেসব মামলা হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট করে মিটমাট করে ফেলে। তার বিপদের সময় আমাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল। তাই আমার বিপদে তার বাড়িতে আশ্রয় দিতে সে পাগল হয়েছিল। এক রাত ধানমন্ডির ১৯ নম্বর রোডের বাড়িতে ছিলামও। আমি চলে গেলে ছেলেমেয়ে নিয়ে মা ওখানে অনেক দিন ছিল। খোকনের বাসা থেকে গিয়েছিলাম জিগাতলায় গৌরাঙ্গীর আশরাফ গিরানীর খালাতো ভাই সিরাজগঞ্জের মোহনের বাসায়। মোহন কিছুটা অসুস্থ ছিল। এখন আর সে নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বেশ কয়েক বছর আগে পরপারে চলে গেছে। তার স্ত্রী খুব কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের বড় করেছে। মানুষ যে মানুষকে কত ভালোবাসতে পারে কোনো কোনো সময় কাউকে কাউকে না দেখলে তা বোঝা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা আমাকে পেলে টুকরো টুকরো করত। কেউ ধরে দিলে তাকে লাখ টাকা পুরস্কার দিত। ওই সময় তোমার খুনিরা পেলেও আদর করে চুমু খেত না। তারা কয়েক টুকরো বেশি করত। এমনিতেই আমি লম্বাচূড়ায় সাধারণ বাঙালির চেয়ে একটু বেশি। তার ওপর স্বাধীনতার পর লম্বা দাড়ি-চুল রাখায় সহজে সবাই চিনতে পারত। তাই ঠিক করা হলো ওগুলো কেটে ফেলা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দাড়ি-চুলে হাত পড়েনি। পরে পরিমাণমতো কাটা হতো। কিন্তু সে দিন দাড়ি-চুল কেটে একেবারে ছোট করে ফেলা হলো। বাইরের সুশীল এলে জানাজানি হতে পারে তাই আশরাফ গিরানী নিজেই কাঁচি ধরল। ঘাটাইলের গৌরাঙ্গীর আশরাফ গিরানী পেছনের একগোছা চুল কেটে অঝোরে কাঁদতে লাগল। দুলাল, লুৎফর, বাবুল হক ওরাও কাঁদছিল। ওদের কান্না দেখে মোহন আর মোহনের বউয়ের সে কী কান্না। মা-বাবাকে কাঁদতে দেখে ওদের বাচ্চাও আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। সারা বাড়িতে দাড়ি-চুল কাটতে নিয়ে সে এক হৃদয়বিদারক কান্নার রোল পড়ে গেল। অথচ কতটা নিষ্ঠুর হলে তোমার মতো পিতাকে গুলি করে হত্যা করতে পারে! গিরানী বোধহয় জীবনে কোনো দিন চুল কাটেনি। দাড়ি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। অনভ্যস্ত হলেও দাড়িগোঁফ সমান করে কেটে ফেলেছিলাম। চুল কাটাটা কেমন যেন উদ্ভট হয়েছিল। ও সময় তা নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু দাড়ি-চুল কাটা হয়ে গেলে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছিলাম না। ওতে একটু সাহস পেয়েছিলাম। নিজেই যখন নিজেকে চিনতে পারছি না তখন শত্র“রা চিনবে কী করে! কয়েক দিন থেকে চিন্তা করেছিলাম টাঙ্গাইল পাহাড়ি অঞ্চলে চলে যাবো। গত তিন দিন কারো সাথে দেখা হয়নি। শুধু শুশু ছিল একমাত্র ভরসা। ছোটবেলা থেকেই রহিমা বেশি কান্নাকাটি করত। তাই ওর সাথে দেখা হয়নি। যে মা চলনরহিত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন সেই মা একাই পিজি থেকে বাড়ি ফিরেছেন। আমি বেরোনোর পরই ২০-৩০ বাবর রোডের বাড়িতে জালেম ফারুক-রশিদের লেলিয়ে দেয়া খুনি বাহিনী এসেছিল। আমাকে না পেয়ে এটা-ওটা দেখিয়ে চটপট চলে গেছে। তখনো বিয়েশাদি করিনি। ভাইবোন-সহকর্মীরা কে কোথায় তার কিছু জানি না। একটা দম বন্ধ অবস্থা। জিগাতলায় একরাত কাটিয়ে এলাম ধানমন্ডি, ড. আর এ গনির বাড়িতে। আর এ গনির স্ত্রী এলি খালা। আমি যেমন এলি খালা বলে ডাকতাম, এলি খালাও আমায় কাদের মামা বলে ডাকতেন। সে জন্য খালার স্বামী আর এ গনিকে খালু না বলে মামা বলে ডাকতাম। এখনো ডাকি। তিনিও আমায় মামা বলে ডাকেন। এখন তিনি বিএনপির একজন বেশ বড়সড় নেতা। তারা তোমার পরে চার-পাঁচবার দেশ শাসন করেছে। জাতীয় পার্টি নামেরও দল আছে। তোমার সময় এসবের কিছুই ছিল না। শুনেছি একসময় ড. আর এ গনি বীরোত্তম জিয়াউর রহমানকে কোনো কিছু পরিয়ে ছিলেন তাই জিয়াউর রহমান তাকে খুবই সম্মান করতেন। যে কারণে দলের নেতাদের কাছে এবং বিএনপির কাছে এখনো সম্মান পান। (চলবে)

রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

শক্তিমান তিন নেতা ও স্মৃতিময় ধানগড়া



ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম

মে মাসের ৪, ৫ ও ৬ তারিখ ছিল বাংলাদেশের জন্য এক রাজনৈতিক সুনামি। ৪ তারিখ এলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ৫ তারিখ দুপুরে পরাশক্তিধর আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, রাত ৯টায় ভারতের বর্ষীয়ান নেতা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। সরকার এবং প্রধান বিরোধী দলের তত্পরতার শেষ ছিল না। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা ছিল অর্থনীতির ওপর। অর্থনীতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অবশ্যম্ভাবী হলেও আগ বাড়িয়ে কোনো উপদেশ দেননি। তবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে কড়কড়ে সত্য বলেছেন। বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাটি আগে মিটিয়ে ফেলা উচিত। জাপানের একার পক্ষে পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ অর্থ যোগান সম্ভব নয়। আমরা কেন যেন বোঝেও বোঝার চেষ্টা করি না। ভিক্ষা করে কি রাজরাজড়ার মেজাজ দেখানো সম্ভব? একেবারেই না। হিলারি ক্লিনটন মনে হয় ২০-২২ ঘণ্টা ছিলেন। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির আসার কথা চলছিল প্রায় দুই-তিন মাস থেকে। তাই হোটেল সোনারগাঁওয়ে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বহু আগে। শুনেছিলাম এক বনে দুই বাঘ থাকে না। এবার দেখলাম এক হোটেলে দুই দেশের মন্ত্রীও থাকে না বা থাকতে পারে না। কেন যে পৃথিবীর মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে—ব্যাপারটি কোনোমতেই মিলছে না। ইদানীং তো কূটনৈতিক খেলায় গোল দিলেও জিত, গোল খেলেও জিত। তা না হলে সমুদ্র সীমা বিজয়ের বাহানায় বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে বলে কত উত্সব হলো! অন্যদিকে যে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ তারাও আচ্ছা করে বিজয় দিবস পালন করল। যাক তবুও শান্তি সুস্থিতি বজায় থাকলেই হলো। তবে কূটনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ মনে করে আমেরিকা না আওয়ামী লীগ, না বিএনপির দিকে। কিন্তু ভারতে কংগ্রেস সরকার হলে চোখ-কান বুজে আওয়ামী লীগ। এইবারই প্রথম বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখার্জি একটা প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন। তা হলো কোনো দলের সঙ্গে নয়, ভারত চায় বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই যদি হয় তাহলে ভারতে যাওয়ার জন্য যে ভিসার গজব সেটাকে তো একটু সহজ ও সুন্দর করতে হবে। সীমান্তে ফেলানীদের যখন তখন গুলি করে মারা যাবে না। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে। সেই কবে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় পাঁচ লাখ টন চাল দেয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত এক ছটাকও দেয়া হয়নি। প্রায় দেড় বছর হয় একশ’ কোটি ডলার ঋণচুক্তি হয়েছে। তার এক টাকাও পাওয়া যায়নি। এরকম হলে তো কেউ কাউকে বিশ্বাস করবে না। বয়স তো আর কম হলো না। পাকিস্তান আমলেও রাস্তাঘাটে যতটা না ভারত বিদ্বেষ দেখা গেছে, বর্তমানে ভারতের প্রতি নতজানু সরকারের আমলে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি দেখা যাচ্ছে। কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখলে কোনো সমাধান হবে না। চোখ-কান খুলে নিরাসক্তভাবে সবকিছু দেখে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া তাও নাকি ভারতের কারসাজি। এই অঞ্চলের মানুষ যখন কোনো কিছু বলতে শুরু করে তা কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিদেশি নাগরিক গওহর রিজভী ও ড. মশিউর রহমান এতদিন জোর দিয়ে বললেন, তিস্তা চুক্তি হবে, পানির ন্যায্য হিস্যা পাব। এবার তো দিল্লি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে, এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কোনো অগ্রগতি না হলে তিস্তা চুক্তি সম্ভব না। আমাদের কী দুর্গতি। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে এতিমের মতো বসে থেকে একটি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। সামান্য মর্যাদাবোধ থাকলে ওখান থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র লিখে নিয়ে আসতেন। রাজস্থানের রাজপুত নারীদের সম্পর্কে শুনেছি, তাদের পুরুষরা কোথাও যুদ্ধে গিয়ে পরাজিত হলে শত্রুর হাতে পড়ে সম্ভ্রম হারাবেন আশঙ্কায় জহরব্রত পালন করে আত্মহত্যা করতেন। এই পৃথিবীতে এখনও অনেকে আছে, সম্মানের জন্য জীবন দেয়, আবার কেউ কেউ সামান্য লাভের জন্য সম্মান দেয়। যাক এখন আর মান-মর্যাদার কথা বলে কোনো লাভ নেই। তা না হলে কত তেল মর্দন করে, ফুলচন্দন দিয়ে মিসেস হিলারিকে বাংলাদেশে আনা হলো। সফর শেষ হতে না হতেই অর্থমন্ত্রী হাত-পা ছুড়ে কটমট করে যা বললেন, তা কিন্তু শাশ্বত বাঙালির কৃষ্টি-সভ্যতা নয়। আমাদের সভ্যতায় অতিথিকে কটুবাক্য প্রয়োগের নজির নেই, বরং অতিথির কটুবাক্য সহ্য করার বহু নজির আছে। নোবেল পাওয়ার জন্য ড. ইউনূসকে পছন্দ না হলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু তাই বলে জাতীয় ঐতিহ্য নষ্ট করতে হবে এটা কেমন কথা? অর্থমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় থেকেই সুবিধায় থাকতে থাকতে মনে হয় বেপরোয়া হয়ে গেছেন। তা না হলে একজন সম্মানিত বিদেশি অতিথি সম্পর্কে অমন বলতে অবশ্যই রুচিতে বাঁধতো। তিনি একক ব্যক্তি হিসেবে অমনটা করলেও গ্রহণযোগ্য হতো না। উপরন্তু রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে অমনটা করেছেন, তাই এ ব্যাপারে অবশ্যই তার জাতির সামনে জবাব দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সোচ্চার হতে আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা একটা চরম অস্বস্তিকর সময় অতিক্রম করছি। তাই সবার কাছে আশা করব, আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সামান্য সচেষ্ট হই তাহলে জাতির এই ক্রান্তিকাল অবশ্যই দূর হতে বাধ্য।
গত পর্বে ধানগড়ার নাজির হোসেনের স্ত্রীর ইন্তেকালের কথা লিখেছিলাম, এ ব্যাপারে আর একটু অগ্রসর হতে চাই। কারণ সেটা আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক কথা সেটা। তাই প্রিয় পাঠক, সেই প্রসঙ্গটা শেষ করে আসি।
বিকাল সাড়ে ৫টায় মোহাম্মদপুর থেকে রওনা হয়ে সাড়ে ৮টায় ধানগড়ায় নাজির হোসেনের বাড়ি পৌঁছি। আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো সেদিনও করটিয়া-টাঙ্গাইলে ব্যাপক ঝড়-তুফান হলেও এলেঙ্গার পর কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। কালিহাতীতে দেখলাম মেঘের ডাকাডাকি আছে কিন্তু একফোঁটা বৃষ্টি নেই। নাগবাড়ী থেকে ধানগড়া রাস্তা ভালো নয়। আগে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যেত না। নাগবাড়ী আবুল হাসান চৌধুরীদের বাড়ির সামনে একটা ছোট কালভার্টের কাজ হচ্ছে। পারাপার এমন দুর্গম করা হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। তবুও গাঁজার নৌকা যেমন পাহাড় দিয়ে যায় আমার গাড়িও তেমনি সব জায়গা দিয়েই যায়। ’৯০-এ গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে ফিরলে এদেশের একজন মহত্প্রাণ শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম ঢাকা মেট্রো ভ-৭৭০০ একটা ২৬০০ সিসির রকি জিপ আমায় উপহার দিয়েছিলেন। শুধু রকি জিপ নয়, সেই ’৬২-র পর থেকে আমৃত্যু কত হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন তার কোনো হিসাব নিকাশ নেই। কিন্তু কোনো দিন কোনো তদবির নিয়ে আসেননি। শুধু একবার বিএনপি সরকারের আমলে তাদের কয়েকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলে কয়েক মাস আওয়ামী লীগের মাসোহারা দিতে পারবেন না সেটা একটু জননেত্রীকে জানাতে অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া কোনো দিন আর অন্য কোনো কথা বলেননি। সেই গাড়ি দেশের কোনো আতর-বাতর, খাল-খন্দ, নদী-নালা নেই যেখানে যায়নি। এমনকি বুক সমান পানির মধ্য দিয়েও ধলেশ্বরী নদী পার হয়েছে। ইদানীংকালের গাড়িঘোড়া তেমন শক্তিশালী নয়। তবু আমি যে গাড়ি চালাই সে গাড়ি জানে হাইল্যা, জাইল্যার হাতে পড়লে কেমন হয়। তাই তেমন ওজর-আপত্তি করে না, সুড়সুড় করে সব জায়গা দিয়ে চলে। সেদিনও কাদা পানি ভেঙে আমাকে নিয়ে তাকে ধানগড়া যেতে হয়েছিল। নাগবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রানা সিদ্দিকী, বাংড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসমত আলী নেতা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বীর প্রতীক, টাঙ্গাইল জেলা সভাপতি এএইচএম আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলামসহ ৪০-৫০ জন সঙ্গে ছিল। আমি যখন ধানগড়া পৌঁছি তখন নাজির হোসেন জায়নামাজে ছিলেন। ঘরভর্তি মানুষ। এলাকার সবার কাছে আমি যেমন পরিচিত তারাও আমার কাছে। বাড়ির ছেলে মেয়েরা আমার সন্তানের মতোই। ও বাড়িতে আমার কত যে নাতিপুতি হিসাব মেলানো ভার। কারও দাদা, কারও নানা, ভাই, চাচা, মামা সম্পর্কের শেষ নেই। বছরে দু’একবার ধানগড়ায় যাওয়া হয়। সেদিন যে ঘরে গিয়ে বসেছিলাম ওখানেই ৪১ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ভাঙা ঘর ছিল। নাজির হোসেনের দু’হাত চেপে ধরে বুকে টেনে নিতে কত কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল প্রথম ওবাড়ি গিয়ে প্রায় বিশ-পঁচিশ দিন পর মা-বাবা, ভাইবোনদের দেখা পেয়েছিলাম। সেই সব স্মৃতি সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠা ছায়াছবির মতো একেক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী বীর বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত মা-বাবা, ভাইবোন টাঙ্গাইলেই ছিলেন। ২৫ মার্চ মাকে গ্রামের বাড়ি রেখে আসি। বাবা মোটরসাইকেল নিয়ে ছাতিহাটি টাঙ্গাইল ঘোরাফেরা করতেন। ৩ এপ্রিল যেদিন গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধ হয় সেদিন বাবা ছাতিহাটি গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার সময় মা-ই প্রায় একশ’জনের খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওর পরে কত পাহাড় ভর করেছি, সীমান্তের কাছে ফুলপুর থানার ওসি মমতাজ অবাঙালি বলে ১৪-১৫ জন সহকর্মীসহ একদিন বন্দি করে রেখেছিল। এরপর আবার ফিরে এসে আশ্রয়হীনভাবে কত জায়গায় ঘোরাফেরা করেছি। মাঝে মধ্যে মা-বাবা, ভাইবোনের কথা মনে হয়েছে। কেউ বাবাকে দেখেছে, কেউ ছোট ভাইদের। মনে মনে সান্ত্বনা পেয়েছি, ভেবেছি, রাস্তাঘাটহীন গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ভালোই আছেন। কিন্তু আমি মোটেই ভালো নেই। এক সময় আমরা অনেক ছিলাম। কিছুই করতে পারছি না বলে ৭-৮ দিন আগে সবাইকে বিদায় করেছি। কিন্তু সিলেটের ফারুক ও ইকবাল তখনও পিছু ছাড়েনি। দু’দিন পর সেই ইকবালকেও পিছু ছাড়া করেছি। সঙ্গে তখন শুধু একমাত্র ফারুক, ১৭ এপ্রিল দুপুরে উপলদিয়ার ফজলুদের বাড়িতে খেতে বসেছি। আমরা তখন সবাই মাটিতে পিঁড়িতে বসে খেতাম। ৬-৭ জনকে খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাত্ ফজলুর ছোট ভাই ১০-১২ বছরের রঞ্জু বলল, ‘মা, বজ্র ভাইর ছোট ভাই বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম।’ কথাটা শুনে কেমন যেন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। ‘বেল্লালকে তুই কোথায় দেখলি?’
— দেওপাড়ার কাছে।
— সত্যিই তুই দেখেছিস?
— হ্যাঁ, বেল্লালকে চিনব না?
— কথা বলেছিস?
— না, দুলাভাইয়ের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, তখন রাস্তা দিয়ে বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম। আমি আর সাহস করে এগিয়ে যাইনি।
বেল্লাল আমার থেকে চারজনের ছোট। তখন ওর আর বয়স কত— বারো-তেরো হবে। কান্নাকাটি আমাদের বাড়িতে নতুন কিছু নয়। একশ’জন মিলেমিশে কাঁদলেও আমার সমান হবে না। বাবার পিটুনি খেয়ে কেঁদেছি। বড় ভাইয়ের মার খেয়ে কেঁদেছি। মায়ের কাছে এটা-ওটা বায়না ধরে না পেয়ে কেঁদেছি। স্কুলে শিক্ষকদের বেত খেয়ে কেঁদেছি। ছেলেবেলায় আমার কাঁদার অন্ত ছিল না। কিন্তু তারপরও হঠাত্ করে ছোট ভাইয়ের কান্নার কথা শুনে বুক খান খান হয়ে গিয়েছিল। ভাত আর মুখে যাচ্ছিল না। কেমন যেন গলা শুকিয়ে আসছিল। তখনই ফজলুর মাকে বলে বিদায় নিয়েছিলাম। তিনি বিদায় দিতে চাননি তবুও নিয়েছিলাম। ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। চিরসঙ্গী ফারুক আর ফজলু ও রতনপুরের ফারুক এগিয়ে দিতে এসেছিল। ওদের বাড়ি থেকে প্রায় চার-পাঁচ মাইল পুবে নজরুলদের কাছতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এরপর দু’জন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সবচেয়ে দরিদ্র আত্মীয় ভোজদত্তের ফুপা মোকাদ্দেছ আলী খানের বাড়ী গিয়েছিলাম। আমাদের এই ফুপু গরিব হলেও আমাদের সবচেয়ে বেশি আদর-যত্ন করতেন। তার আদর ভালোবাসায় কোনো উজান-ভাটি দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই চরম দিনগুলোতেও না। এমনিতে তাদের দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা। কিন্তু তবু আমরা গেলে কী যে আদর-যত্ন করতেন। কোনো দিন মোরগ-মুরগি জবাই করে না খাইয়ে ছাড়তেন না। সেদিনও ছাড়েননি। বুঝতাম আমি তার ভাইয়ের ছেলে। তাই অত আদর। কিন্তু তখন যে প্রতিদিনই পাকিস্তান হানাদাররা আমার মাথার দাম লাখ টাকা ঘোষণা করে চলেছে। ধরে দিলেই লাখ টাকা পুরস্কার। আশ্রয় দিলে জীবননাশ। তারপরও তিনি ছাড়লেন না। ভাইপোকে খাওয়াতেই হবে। রাত ৯টার দিকে ছাড়া পেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটির দিকে রওনা হলাম।
(চলবে)