বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এবারও বিরোধী দল ছাড়া সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হলো। এমন নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও গুরুত্বহীন সংসদ দুনিয়ায় আর কোথাও আছে কি-না আমরা কেউ জানি না। কেউ কেউ বলছেন, বিরোধী দলের সংসদে যাওয়া উচিত। দেশের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হলো সংসদ। কিন্তু বাস্তবে বর্তমান সংসদের মর্যাদা বা গুরুত্ব মোটেই তেমন নয়। সংসদের কোনো কথাই তেমন কেউ শোনে না, শোনার চেষ্টাও করে না। সবাই জানে কার কথা শুনতে হবে। তাই তারা তার কথাই শোনেন, আর কারও নয়। মনে হয়, এবারই অনেক বেশি সংসদ সদস্যকে কারাগারে রেখে অধিবেশন বসছে। আবার অদ্ভুতভাবে মাননীয় স্পিকার বলেছেন, ‘২০০ একর সংসদ ভবনের সীমার উপর তার কর্তৃত্ব।’ তাহলে মনে হয় তিনি সংসদ ভবনের স্পিকার! বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নন, বাংলাদেশেরও নন? একজন সংসদ সদস্য শুধু সংসদ ভবনের সীমানার জনপ্রতিনিধি নন, সারা দেশের। আর মাননীয় স্পিকারও শুধু রাবার স্ট্যাম্প নন, তিনি অভিভাবক। তার সদস্য যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের প্রতিও তার দায়দায়িত্ব আছে। ইচ্ছে করলেই এক্ষেত্রে নিজের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। মাননীয় স্পিকার বলেছেন, ‘জেলে আবদ্ধ সংসদ সদস্যদের সংসদে আসা না আসা বা আনা না আনার বিষয়ে তার কোনো দায়িত্ব নেই। ব্যাপারটা কোর্ট এবং সরকারের।’ এটা কোনো দায়িত্বশীল স্পিকারের কথা হলো না। কোনো সংসদ সদস্য তো সাজাপ্রাপ্ত নন? শুধু অভিযুক্ত। তারা যদি কেউ ইচ্ছে করেন সংসদে আসবেন, দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই তাদের ঠেকায়। বাংলাদেশের সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধিতে মাননীয় স্পিকারকে যে সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে তার অবশ্যই উচিত ছিল কারাবন্দি সব মাননীয় সদস্যকে চিঠি দিয়ে জানানো তারা সংসদ অধিবেশনে আসতে চান কি-না। যদি তারা সম্মতি দিতেন বা আগ্রহ প্রকাশ করতেন তাহলে তাদের অধিবেশনে আনা ছাড়া মাননীয় স্পিকারের কোনো গত্যন্তর ছিল না। আরও একটু দায়িত্বশীল সাহসী স্পিকার হলে ক্ষতি কী? ৭ম সংসদে স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সময় সংসদ চলাকালে কিশোরগঞ্জের মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামানকে এক ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেফতার করেছিলেন। তার স্ত্রীর পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় স্পিকার সংসদে রুলিং দিয়েছিলেন, একজন থার্ডক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের এ অপতত্পরতা গণতন্ত্র এবং সংসদকে অবমাননার শামিল। সেই ম্যাজিস্ট্রেটকে নোটিশ করে আনা হয়েছিল এবং মাননীয় স্পিকারের রুমে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করে সে যাত্রায় তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। এ-তো সংসদের রেকর্ডেই রয়েছে। সংসদ মর্যাদাশীল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হলে গণতন্ত্র মোটেই সুসংহত হবে না। তাই সংসদকে সংসদের মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো রাবার স্ট্যাম্প হলে চলবে না। এমনটা দেশবাসী কেউ চায়ও না।
ইদানীং কেন যেন সবাই বড় বেশি নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্রে এখন আর কেউ ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় আনে না। কি বললে বা করলে ক্ষণিকের লাভ হবে তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সার্বিক অর্থে সাধারণ মানুষ বড় অসহায়। তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। সাধারণ মানুষও যেন কেমন কাউকে ভরসা করা ভুলে গেছে। তারা কাউকে পাশে পেতে খুব একটা আগ্রহী নয়। সবাই দেখছে দেশ ভাল চলছে না। শুধু কষ্ট আর কষ্ট। কারও কোনো নিরাপত্তা নেই, মান-মর্যাদা নেই। তারপরও ‘রেল চলে ঝমাঝম—পা পিছলে আলুর দম’। সরকার বলছে খুব ভালো, বিরোধী দল বলছে খুব খারাপ। মানুষ দেখছে ভীষণ অসঙ্গতি। কম বেশি সব খানেই অশান্তি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। লক্ষ্য করার মতো তেমন অর্থনৈতিক সফলতা নেই। শেয়ারবাজার লুটপাট, ফটকাবাজ নানা কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণা করে মানুষকে দিনের পর দিন সর্বস্বান্ত করে চলেছে। ‘ডেসটিনি-২০০০’ বলে একটি সংস্থার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের ৩৪টির হিসাব জব্দ। রাজনৈতিক হানাহানি, কাটাকাটি তো লেগেই আছে। চর দখলের মতো সর্বত্র চলছে সবকিছু দখল। দুর্নীতিই যেন সুনীতি হিসেবে স্থান দখল করেছে। বিদেশি আগ্রাসন তো আছেই। ভূমিতে, আকাশে, বাতাসে সর্বত্র তার আলামত দেখা যাচ্ছে। আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক’দিন ধরে বলে চলেছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা এখনও সক্রিয়। তারা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।’ আলামত বেশি ভালো নয়। আমরা কেউ কেন যেন অনেক কিছুই তলিয়ে দেখছি না। দেশের রাজনীতি, সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক গতি ওয়ান-ইলেভেনের কর্মকাণ্ডে একশ’ বছর পিছিয়ে গেছে। সামাজিকভাবে বহু মানুষ অযথা লাঞ্ছিত হয়েছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এলে সাধারণত যেটা হয়, ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে যেমনটা করেছিলেন আরব সাগর থেকে দুর্নীতিবাজদের ফেলে দেয়া টনকে টন সোনা নাকি উদ্ধার করেছিলেন। কত মানুষকে যে ফাটকে ভরে ছিলেন তার কোনো হিসাব-নিকাশ ছিল না। ’৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল ইসকান্দার মির্জা সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করেন। ২০ দিন যেতে না যেতেই তাকে লন্ডনের এক হোটেল ম্যানেজারের চাকরি দিয়ে জেনারেল আয়ুব খান সব ক্ষমতা করায়ত্ত করেন। বছর না ঘুরতেই যাদের কারাবন্দি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন তাদের হাতে-পায়ে অনেক ফুলচন্দন মেখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারা করে ১০ বছর দুর্দান্ত প্রতাপে দেশ চালিয়ে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতাহারা হয়েছিলেন। ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আয়ুব খান ‘প্রভু নয় বন্ধু’ বইতে তার জামানার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। বইটির নাম ‘Friends Not Masters’। আমরা বিরোধীরা বাংলা করেছিলাম ‘বন্ধু নয় প্রভু’। সাধারণত এমনই হয়। বিরোধীদের কাজ বিরোধীরা করে, সরকারের কাজ সরকার করে। রাষ্ট্রব্যবস্থা যতকাল থাকবে ততকাল এ দ্বন্দ্ব থাকবে। এটা কোন দোষের নয়। এটাই বাস্তবতা। সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার এবং বিরোধী দলের প্রচার প্রোপাগাণ্ডা বিচারের মালিক জনগণ। কিন্তু আমার দেশের জনগণ ধীরে ধীরে সেই মালিকানাও হারিয়ে ফেলছে। আজ দেশের মানুষের যে দুরবস্থা এটা সত্যিকার অর্থে তুলে ধরার ক্ষমতা কেউ রাখে না। কারও কোনো স্বস্তি নেই, সুস্থিতি নেই। এক লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো অবস্থা। আপনি বেসরকারি কর্মচারী, বেতনের টাকায় ১৫ দিন চলবে না। আপনি ডাক্তার, ক্লিনিকে না বসলে বেতনের টাকায় বাসা ভাড়া দিতেই শেষ। খাওয়া-দাওয়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, কাপড়-চোপড়, চিকিত্সা—এসব কী দিয়ে চলবে? ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, সরকারি বা বেসরকারি? উপরি না নিলে বেতনের টাকায় গাড়ির তেল খরচও হবে না। একেবারে গ্রামের স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত অথবা যেকোনো কর্মচারী কর্মকর্তার নির্ধারিত বেতনে এখন আর মাস চলে না। নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে সত্ আয় আর ব্যয়ের কোনো সঙ্গতি নেই। দেশবাসীকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। তার ওপর দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশাসনে একেবারেই কেমন যেন একটা উদ্ভট অবস্থা। এই ২০-৩০ বছর আগেও অনেকেই তার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। সরকারি কাজকর্মকে পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করত। কিন্তু এখন আর সরকারি দায়িত্ব কারও কাছে কোনো পবিত্র কিছু নয়। আগে মানুষ ব্যক্তিগত আর সরকারি সম্পদের পার্থক্য করত। কিন্তু এখন যে যত ক্ষমতাবান সে সরকারি সম্পদ আর নিজের সম্পদের কোনো সীমারেখা টানে না। মনে করে সবই তার। ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একই রকম। তা না হলে আজ ক’দিন ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লাগাতার বলছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা ঘুমিয়ে নেই। তারা একইভাবে তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে।’ সরকারি অন্য মুখপাত্ররাও একই কথা বলছে। এটা তারা কাকে বলছেন? যারা বিরোধীদের নামে মামলা দিয়ে ১০-১১ দিনের মধ্যে সব প্রধান প্রধান নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পারেন তাদের? নাকি যারা ৩৯ দিনেও গুম হওয়া ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে পারেন না তাদের? অথবা যারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার হুমকি দিয়েছিলেন তাদের? অথচ ১০০ দিন পেরিয়ে গেল এখনও কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না। বাতাসে শোনা যায়, উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের সম্পৃক্ততাই নাকি ওই ব্যর্থতার কারণ। তাহলে তারা এই সময় ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের তত্পরতায় গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার অশুভ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কার উদ্দেশে এবং কেন? ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের অগণতান্ত্রিক তত্পরতা দেশবাসীর পছন্দ হয়নি বলেই তো মহাজোটকে অমন মহা বিজয়ী করেছিল। ক্ষমতায় বসে সাড়ে তিন বছরেও কেন ওইসব অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের হোতাদের আইনের হাতে সৌপর্দ করা হলো না? মহাজোটের অধিকাংশ নেতাই তো ওয়ান-ইলেভেনে নির্যাতিত। জনাব আবদুল জলিল, শেখ সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, মহীউদ্দীন খান আলমগীর—এরা তো কম নির্যাতিত হননি। আবদুল জলিল এবং মোহাম্মদ নাসিম তো মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। কই, তাদের অমন নির্যাতন অসম্মান যারা করেছিল তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা হলো? কেন হলো না? যেহেতু কোনো রকম ধরা-ছোঁয়া ছাড়াই খুব সহজে পার পেয়ে গেছে তাই তাদের সাহস কিছুটা বেড়ে গেলে দোষ দেবেন কাকে? বেঁচে থাকার জন্য কাজকর্ম তো করবেই, তাই তারা যদি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে তাহলে তাদের দোষ দেবেন কী করে? ওয়ান-ইলেভেনের সরকারপ্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ বাঙালি জাতির সব মান-সম্মান ধুলায় মিলিয়ে দিয়ে পৃথিবীময় বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। নাটের গুরু মইন উ আহমেদ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও কয়েক মাস সেনাপ্রধান ছিলেন। তার কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি। অবসর নেয়ার পরও ভদ্রলোককে কেউ কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তাহলে অমন না হয়ে উপায় কি? ওয়ান-ইলেভেনের এক ইফতারিতে সেনাপ্রধানের দাওয়াতে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলাম। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম হিসেবে আমিই ছিলাম। মেজর জেনারেল আবদুল মতিন এবং জেনারেল মইন উ আহমেদের মাঝে বসিয়ে ছিলেন। মাগরিবের নামাজ শেষে জেনারেল মইন উ আহমেদ খেদ ব্যক্ত করে আমাকে বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মিলিটারিদের নিয়ে এত কিছু তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম অস্ত্রধারণ করেছিল। সেই ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কী সব জঘন্য কথাবার্তা বলছে। এটা একটা ষড়যন্ত্র। একে সহজে মেনে নেয়া হবে না।’ আমিও বলেছিলাম, ‘২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় স্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র -শিক্ষকদের তো তার চাইতে হাজারগুণ প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। ছোট্ট একটি তুচ্ছ ঘটনায় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে তা কোনোমতেই ভাবীকালের ইতিহাস ভালো চোখে দেখবে না।’ বলেছিলাম, ‘ক্ষমতায় থাকলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে না। তাই অমন বলছেন। নিরাসক্তভাবে চিন্তা করলে দেখবেন ছাত্ররা আমাদের সন্তান। পিতা-মাতা হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের কী করা উচিত ছিল। কীভাবে তাদের বুকে আগলে রাখতে হয়।’ হঠাত্ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হলে হল থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রদের শাহবাগের আজিজ মার্কেটসহ অন্যান্য জায়গায় গরুর মতো জোড়ন দিয়ে কী নির্যাতনই না করা হয়েছে। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তারা গাড়িতে উঠতে পারেননি। যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই অত্যাচার করা হয়েছে। কোনো রাষ্ট্র তার সন্তানদের প্রতি অমন নির্মম আচরণ কখনও করে না। যখন যেখানে অমন আচরণ করা হয়েছে, সেখানেই রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। সে দিন রাষ্ট্রযন্ত্রের সেনাবাহিনীর সদস্যদের কী করা উচিত ছিল? উচিত ছিল হানাদার পাকিস্তানিদের মতো না করে আমাদের সন্তানদের নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করা, তাহলে জরুরি অবস্থার কুশীলবদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি পেত। কী প্রয়োজন ছিল অবৈধ উচ্ছেদের নামে একেবারে গ্রামপর্যায়ে শত শত বছরের পুরনো হাট-বাজার ভেঙে চুরমার করে দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে পথে বসানোর? প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই গরীব মানুষগুলো তো সরকারি কোনো কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলেনি। তবে কেন তারা অমন ক্ষতিগ্রস্ত হলো? জরুরি অবস্থা জারি করে যাদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো সেই প্রধান প্রধান অভিযুক্তরাই তো আজ রাষ্ট্র এবং সমাজের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ যিনি এনেছিলেন সেই আজম জে চৌধুরীকে তো একদিনের জন্যও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে যাকে গ্রেফতার করতে হন্যে হয়ে ঘুরছিল সেই ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিম এখন রাস্তাঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্যের সবকিছু তার করায়ত্ত। যে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রধান আহমেদ আকবর সোবহানকে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে আন্ডাবাচ্চাসহ গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছিল, না পেয়ে তার গুলশানের বাড়িঘরে কাঁটা দেয়া হয়েছিল— তিনিই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনকে দুই-আড়াইশ’ কোটি টাকা ভিক্ষে এবং খেলাধুলার জন্য দুটি মাঠের জমি ঘুষ নিয়ে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেছেন। মইন উ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে তার সঙ্গে বেশ বড় বড় ছবি তুলেছিলেন। এসবের কোনো কিছুরই তো প্রতিকার হয়নি। প্রতিকার হয়নি ওয়ান-ইলেভেনের প্রধান নায়ক জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর। ওয়ান-ইলেভেনেও যেমন ছিলেন এখনও তেমন আছেন। রাস্তাঘাটে শোনা যায়, বেগম খালেদা জিয়া বা জিয়াউর রহমানের ছেলে তারেক রহমানের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের পুরস্কার হিসেবেই তিনি নাকি এখনও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে আছেন। এমনকি চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরও হয়তো হবে। যদিও ব্রিগেডিয়ার বারী এবং মেজর জেনারেল আমীন আমেরিকায় লুকিয়ে লুকিয়ে হোটেলে কাজ করছেন। সর্বত্র এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে ওয়ান-ইলেভেনের কুশিলবরা তো সদর্পে থাকবেই। মানুষ তাদের অন্যায় কাজের বিচার প্রত্যাশা করেছিল মহাজোট সরকারের কাছে। তা তারা পায়নি। এ কারণে মানুষ মহাজোটের ওপর খুবই হতাশ।
ইদানীং কেন যেন সবাই বড় বেশি নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্রে এখন আর কেউ ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় আনে না। কি বললে বা করলে ক্ষণিকের লাভ হবে তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সার্বিক অর্থে সাধারণ মানুষ বড় অসহায়। তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। সাধারণ মানুষও যেন কেমন কাউকে ভরসা করা ভুলে গেছে। তারা কাউকে পাশে পেতে খুব একটা আগ্রহী নয়। সবাই দেখছে দেশ ভাল চলছে না। শুধু কষ্ট আর কষ্ট। কারও কোনো নিরাপত্তা নেই, মান-মর্যাদা নেই। তারপরও ‘রেল চলে ঝমাঝম—পা পিছলে আলুর দম’। সরকার বলছে খুব ভালো, বিরোধী দল বলছে খুব খারাপ। মানুষ দেখছে ভীষণ অসঙ্গতি। কম বেশি সব খানেই অশান্তি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। লক্ষ্য করার মতো তেমন অর্থনৈতিক সফলতা নেই। শেয়ারবাজার লুটপাট, ফটকাবাজ নানা কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণা করে মানুষকে দিনের পর দিন সর্বস্বান্ত করে চলেছে। ‘ডেসটিনি-২০০০’ বলে একটি সংস্থার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের ৩৪টির হিসাব জব্দ। রাজনৈতিক হানাহানি, কাটাকাটি তো লেগেই আছে। চর দখলের মতো সর্বত্র চলছে সবকিছু দখল। দুর্নীতিই যেন সুনীতি হিসেবে স্থান দখল করেছে। বিদেশি আগ্রাসন তো আছেই। ভূমিতে, আকাশে, বাতাসে সর্বত্র তার আলামত দেখা যাচ্ছে। আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক’দিন ধরে বলে চলেছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা এখনও সক্রিয়। তারা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।’ আলামত বেশি ভালো নয়। আমরা কেউ কেন যেন অনেক কিছুই তলিয়ে দেখছি না। দেশের রাজনীতি, সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক গতি ওয়ান-ইলেভেনের কর্মকাণ্ডে একশ’ বছর পিছিয়ে গেছে। সামাজিকভাবে বহু মানুষ অযথা লাঞ্ছিত হয়েছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এলে সাধারণত যেটা হয়, ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে যেমনটা করেছিলেন আরব সাগর থেকে দুর্নীতিবাজদের ফেলে দেয়া টনকে টন সোনা নাকি উদ্ধার করেছিলেন। কত মানুষকে যে ফাটকে ভরে ছিলেন তার কোনো হিসাব-নিকাশ ছিল না। ’৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল ইসকান্দার মির্জা সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করেন। ২০ দিন যেতে না যেতেই তাকে লন্ডনের এক হোটেল ম্যানেজারের চাকরি দিয়ে জেনারেল আয়ুব খান সব ক্ষমতা করায়ত্ত করেন। বছর না ঘুরতেই যাদের কারাবন্দি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন তাদের হাতে-পায়ে অনেক ফুলচন্দন মেখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারা করে ১০ বছর দুর্দান্ত প্রতাপে দেশ চালিয়ে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতাহারা হয়েছিলেন। ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আয়ুব খান ‘প্রভু নয় বন্ধু’ বইতে তার জামানার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। বইটির নাম ‘Friends Not Masters’। আমরা বিরোধীরা বাংলা করেছিলাম ‘বন্ধু নয় প্রভু’। সাধারণত এমনই হয়। বিরোধীদের কাজ বিরোধীরা করে, সরকারের কাজ সরকার করে। রাষ্ট্রব্যবস্থা যতকাল থাকবে ততকাল এ দ্বন্দ্ব থাকবে। এটা কোন দোষের নয়। এটাই বাস্তবতা। সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার এবং বিরোধী দলের প্রচার প্রোপাগাণ্ডা বিচারের মালিক জনগণ। কিন্তু আমার দেশের জনগণ ধীরে ধীরে সেই মালিকানাও হারিয়ে ফেলছে। আজ দেশের মানুষের যে দুরবস্থা এটা সত্যিকার অর্থে তুলে ধরার ক্ষমতা কেউ রাখে না। কারও কোনো স্বস্তি নেই, সুস্থিতি নেই। এক লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো অবস্থা। আপনি বেসরকারি কর্মচারী, বেতনের টাকায় ১৫ দিন চলবে না। আপনি ডাক্তার, ক্লিনিকে না বসলে বেতনের টাকায় বাসা ভাড়া দিতেই শেষ। খাওয়া-দাওয়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, কাপড়-চোপড়, চিকিত্সা—এসব কী দিয়ে চলবে? ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, সরকারি বা বেসরকারি? উপরি না নিলে বেতনের টাকায় গাড়ির তেল খরচও হবে না। একেবারে গ্রামের স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত অথবা যেকোনো কর্মচারী কর্মকর্তার নির্ধারিত বেতনে এখন আর মাস চলে না। নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে সত্ আয় আর ব্যয়ের কোনো সঙ্গতি নেই। দেশবাসীকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। তার ওপর দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশাসনে একেবারেই কেমন যেন একটা উদ্ভট অবস্থা। এই ২০-৩০ বছর আগেও অনেকেই তার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। সরকারি কাজকর্মকে পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করত। কিন্তু এখন আর সরকারি দায়িত্ব কারও কাছে কোনো পবিত্র কিছু নয়। আগে মানুষ ব্যক্তিগত আর সরকারি সম্পদের পার্থক্য করত। কিন্তু এখন যে যত ক্ষমতাবান সে সরকারি সম্পদ আর নিজের সম্পদের কোনো সীমারেখা টানে না। মনে করে সবই তার। ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একই রকম। তা না হলে আজ ক’দিন ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লাগাতার বলছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা ঘুমিয়ে নেই। তারা একইভাবে তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে।’ সরকারি অন্য মুখপাত্ররাও একই কথা বলছে। এটা তারা কাকে বলছেন? যারা বিরোধীদের নামে মামলা দিয়ে ১০-১১ দিনের মধ্যে সব প্রধান প্রধান নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পারেন তাদের? নাকি যারা ৩৯ দিনেও গুম হওয়া ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে পারেন না তাদের? অথবা যারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার হুমকি দিয়েছিলেন তাদের? অথচ ১০০ দিন পেরিয়ে গেল এখনও কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না। বাতাসে শোনা যায়, উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের সম্পৃক্ততাই নাকি ওই ব্যর্থতার কারণ। তাহলে তারা এই সময় ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের তত্পরতায় গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার অশুভ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কার উদ্দেশে এবং কেন? ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের অগণতান্ত্রিক তত্পরতা দেশবাসীর পছন্দ হয়নি বলেই তো মহাজোটকে অমন মহা বিজয়ী করেছিল। ক্ষমতায় বসে সাড়ে তিন বছরেও কেন ওইসব অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের হোতাদের আইনের হাতে সৌপর্দ করা হলো না? মহাজোটের অধিকাংশ নেতাই তো ওয়ান-ইলেভেনে নির্যাতিত। জনাব আবদুল জলিল, শেখ সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, মহীউদ্দীন খান আলমগীর—এরা তো কম নির্যাতিত হননি। আবদুল জলিল এবং মোহাম্মদ নাসিম তো মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। কই, তাদের অমন নির্যাতন অসম্মান যারা করেছিল তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা হলো? কেন হলো না? যেহেতু কোনো রকম ধরা-ছোঁয়া ছাড়াই খুব সহজে পার পেয়ে গেছে তাই তাদের সাহস কিছুটা বেড়ে গেলে দোষ দেবেন কাকে? বেঁচে থাকার জন্য কাজকর্ম তো করবেই, তাই তারা যদি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে তাহলে তাদের দোষ দেবেন কী করে? ওয়ান-ইলেভেনের সরকারপ্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ বাঙালি জাতির সব মান-সম্মান ধুলায় মিলিয়ে দিয়ে পৃথিবীময় বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। নাটের গুরু মইন উ আহমেদ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও কয়েক মাস সেনাপ্রধান ছিলেন। তার কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি। অবসর নেয়ার পরও ভদ্রলোককে কেউ কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তাহলে অমন না হয়ে উপায় কি? ওয়ান-ইলেভেনের এক ইফতারিতে সেনাপ্রধানের দাওয়াতে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলাম। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম হিসেবে আমিই ছিলাম। মেজর জেনারেল আবদুল মতিন এবং জেনারেল মইন উ আহমেদের মাঝে বসিয়ে ছিলেন। মাগরিবের নামাজ শেষে জেনারেল মইন উ আহমেদ খেদ ব্যক্ত করে আমাকে বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মিলিটারিদের নিয়ে এত কিছু তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম অস্ত্রধারণ করেছিল। সেই ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কী সব জঘন্য কথাবার্তা বলছে। এটা একটা ষড়যন্ত্র। একে সহজে মেনে নেয়া হবে না।’ আমিও বলেছিলাম, ‘২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় স্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র -শিক্ষকদের তো তার চাইতে হাজারগুণ প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। ছোট্ট একটি তুচ্ছ ঘটনায় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে তা কোনোমতেই ভাবীকালের ইতিহাস ভালো চোখে দেখবে না।’ বলেছিলাম, ‘ক্ষমতায় থাকলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে না। তাই অমন বলছেন। নিরাসক্তভাবে চিন্তা করলে দেখবেন ছাত্ররা আমাদের সন্তান। পিতা-মাতা হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের কী করা উচিত ছিল। কীভাবে তাদের বুকে আগলে রাখতে হয়।’ হঠাত্ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হলে হল থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রদের শাহবাগের আজিজ মার্কেটসহ অন্যান্য জায়গায় গরুর মতো জোড়ন দিয়ে কী নির্যাতনই না করা হয়েছে। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তারা গাড়িতে উঠতে পারেননি। যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই অত্যাচার করা হয়েছে। কোনো রাষ্ট্র তার সন্তানদের প্রতি অমন নির্মম আচরণ কখনও করে না। যখন যেখানে অমন আচরণ করা হয়েছে, সেখানেই রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। সে দিন রাষ্ট্রযন্ত্রের সেনাবাহিনীর সদস্যদের কী করা উচিত ছিল? উচিত ছিল হানাদার পাকিস্তানিদের মতো না করে আমাদের সন্তানদের নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করা, তাহলে জরুরি অবস্থার কুশীলবদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি পেত। কী প্রয়োজন ছিল অবৈধ উচ্ছেদের নামে একেবারে গ্রামপর্যায়ে শত শত বছরের পুরনো হাট-বাজার ভেঙে চুরমার করে দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে পথে বসানোর? প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই গরীব মানুষগুলো তো সরকারি কোনো কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলেনি। তবে কেন তারা অমন ক্ষতিগ্রস্ত হলো? জরুরি অবস্থা জারি করে যাদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো সেই প্রধান প্রধান অভিযুক্তরাই তো আজ রাষ্ট্র এবং সমাজের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ যিনি এনেছিলেন সেই আজম জে চৌধুরীকে তো একদিনের জন্যও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে যাকে গ্রেফতার করতে হন্যে হয়ে ঘুরছিল সেই ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিম এখন রাস্তাঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্যের সবকিছু তার করায়ত্ত। যে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রধান আহমেদ আকবর সোবহানকে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে আন্ডাবাচ্চাসহ গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছিল, না পেয়ে তার গুলশানের বাড়িঘরে কাঁটা দেয়া হয়েছিল— তিনিই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনকে দুই-আড়াইশ’ কোটি টাকা ভিক্ষে এবং খেলাধুলার জন্য দুটি মাঠের জমি ঘুষ নিয়ে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেছেন। মইন উ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে তার সঙ্গে বেশ বড় বড় ছবি তুলেছিলেন। এসবের কোনো কিছুরই তো প্রতিকার হয়নি। প্রতিকার হয়নি ওয়ান-ইলেভেনের প্রধান নায়ক জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর। ওয়ান-ইলেভেনেও যেমন ছিলেন এখনও তেমন আছেন। রাস্তাঘাটে শোনা যায়, বেগম খালেদা জিয়া বা জিয়াউর রহমানের ছেলে তারেক রহমানের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের পুরস্কার হিসেবেই তিনি নাকি এখনও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে আছেন। এমনকি চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরও হয়তো হবে। যদিও ব্রিগেডিয়ার বারী এবং মেজর জেনারেল আমীন আমেরিকায় লুকিয়ে লুকিয়ে হোটেলে কাজ করছেন। সর্বত্র এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে ওয়ান-ইলেভেনের কুশিলবরা তো সদর্পে থাকবেই। মানুষ তাদের অন্যায় কাজের বিচার প্রত্যাশা করেছিল মহাজোট সরকারের কাছে। তা তারা পায়নি। এ কারণে মানুষ মহাজোটের ওপর খুবই হতাশ।